২০২০ সালের মার্চ মাস। দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। প্রবাসীসহ অনেকেই করোনা পরীক্ষা করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দেখা দেয় কিট সংকট। এমন পরিস্থিতিতে করোনা শনাক্তে স্বল্পমূল্যে ও দ্রুত টেস্টিং কিট উদ্ভাবনের কথা জানায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। দেশবাসীর মনে তীব্র আশার সঞ্চার হয়। মহামারি বিবেচনায় দ্রুত কিট বাজারে আনার অনুমোদনের আবেদন জানায় গণস্বাস্থ্য।


সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কাছে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লোট’ প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবিত টেস্ট কিটের নমুনা হস্তান্তর নিয়ে শুরু হয় নাটকীয়তা। গণস্বাস্থ্যের কিটের নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যাননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। এরপর সিআরও (কনট্রাক্ট রিসার্চ ফার্ম) প্রতিষ্ঠান নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা।


ওষুধ প্রশাসন ও গণস্বাস্থ্যের সেই দ্বন্দ্বও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। একপর্যায়ে গণস্বাস্থ্যের দাবি মেনে ‘নামসর্বস্ব’ সিআরও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিটের সক্ষমতা পরীক্ষার পক্ষে মত দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।


গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত টেস্ট কিটের কার্যকারিতা যাচাইয়ে কমিটি গঠন করা হয়। একমাস ধরে সেই কমিটি কাজ করে। ওই বছরের জুনের শেষ দিকে কমিটি জানায়, গণস্বাস্থ্যের কিট কার্যকর নয়। তবে গণস্বাস্থ্য দাবি করে, বিএসএমএমইউ’র পরীক্ষায় তাদের কিট ৭০ শতাংশ সফল। ওই সময়ে এমন সফল কিট বিশ্বের কোথাও নেই।


ওই বছরের আগস্টে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সবকিছু বিবেচনায় এটা বাজারে আসার সম্ভাবনা কম, নেই বললেও চলে। তবে আমরা আরেকটু ধৈর্য ধরতে চাই। সরকারের ইচ্ছা থাকলে দিয়ে দিতো। এতে আমাদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। বঞ্চিত হয়েছে দেশের জনগণ।’


গত ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার রাতে মারা যান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার সহকর্মী, বিশিষ্টজন, রাজনৈতিক নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়ে। সেখানে কথা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টুর সঙ্গে, যিনি ২০১৮ সাল থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী।


গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট বাজারে না আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিট বাজারজাত ও ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আক্ষেপ ছিল। তিনি বলতেন, দেশের বড় ক্ষতি হয়েছে। দুর্নীতির সুযোগ তৈরির জন্যই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি এমন কথা বার বার বলে গেছেন। করোনাকালে কিট উৎপাদন করে আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারতাম।


ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাদামাটা জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উনি ২০০ টাকার স্যান্ডেল, বোতাম ছেড়া একটা শার্ট ২৮-৩০ বছর পর্যন্ত পরেছেন। তালি দেওয়া একটা প্যান্ট পরতেন। উনার গাড়ি প্রায়ই বিকল হয়ে যেতো রাস্তায়। রাস্তায় গাড়ি ঠিক হতো, উনি ফুটপাতে বসে থাকতেন। এমন অনেক বার হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের পর তিনি বিলাসিতা বাদ দিয়েছেন।’


জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু বলেন, ‘তাকে প্রায়ই নতুন গাড়ি কেনার কথা বলতাম। তিনি বলতেন, এ দেশের অনেক মানুষ ঠিকমতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। তরুণদের চাকরি নেই। আমি তাদের ঘর দিতে পারি না, চাকরি দিতে পারি না। অথচ আমাদের ওয়াদা ছিল স্বাধীনতার পর মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হবে। ডা. জাফরুল্লাহ সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও খুব সাধামাটা জীবনযাপন করতেন। সাহায্যের জন্য উনার কাছে কেউ গেলে তাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হতো না।’


জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৭২ সাল থেকে মৃত্যু অবধি কাজ করেছেন। যখন যে সরকার ছিল, তার সমালোচনা করেছেন। যারা বিরোধী দলে ছিল তাদের উৎসাহ দিয়েছেন।’

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024