|
Date: 2023-05-08 18:05:15 |
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম একটি এলাকার নাম আঠারবাড়ি। সময়ের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত আঠারবাড়ি জমিদারবাড়ির অতীত ঐতিহ্য আজ হারানোর পথে। তৎকালীন জমিদারের রেখে যাওয়া সম্পত্তির অনেকাংশই আজ নষ্টের পথে। অযতœ ,অবহেলা, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জমিদারবাড়িতে প্রবেশের মূল ফটক (সিংহদরজা),নাটমন্দির ও কয়েকটি ঘর ছাড়া প্রায় সকল শৈল্পিক স্থাপনাই ধ্বংসের পথে। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও জমিদারবাড়িকে কেন্দ্র করে আজও গড়ে ওঠেনি কোনো পর্যটনকেন্দ্র । ফলে আঠারবাড়ি জমিদার বাড়ি এখন শুধুই কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ১৯১০ সালে তৎকালীন জমিদার মহিম চন্দ্র রায় জমিদারবাড়ির সুবিশাল পুকুর সংলগ্ন মনোরম পরিবেশে আঠারবাড়ি এম সি উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরী পরিবার -পরিজন সহ ভারতে চলে যান । পরবর্তীতে ১৯৬৮ সনে জমিদারবাড়ির আঙ্গিনায় আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজ স্থাপিত হয় । আঠারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুবের আলম কবীর রুপক জানান, প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থী জমিদারবাড়ি দেখতে আসেন। জমিদারবাড়িটি আমাদের উপজেলাবাসীর গর্ব । আগামী প্রজন্মকে এর ইতিহাস জানাতে হলে উক্ত বাড়িটির সংরক্ষণ জরুরী ।
উপজেলা সদর হতে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পূর্বে অপরুপ কারুকার্যময় এই জমিদার বাড়ির বয়স প্রায় আড়াইশ বছর । জানা যায়, ১৮৫৩ সালে বিবি এজিনার অংশ মতান্তরে কেসপার্জের অংশ ক্রয় করেন আঠারবাড়ির জমিদার শম্ভূ রায় চৌধুরী । পরে মুক্তাগাছার জমিদার রাম কিশোর চৌধুরীর জমিদারি ঋণের দায়ে নিলামে উঠলে তা শম্ভূরায় চেীধুরীর পুত্র মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী কিনে নেন। জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর তাদের আয়ত্বে আসে উত্তরে গৌরীপুরের রাজবাড়ি, পশ্চিমে রামগোপালপুর, ডৌহাখলা দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। প্রতি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এসব জেলা শহরে স্থাপিত আঠারবাড়ি কাচারি বাড়িতে নায়েব উপস্থিত হয়ে খাজনা আদায় করতেন। আজও এসব কাচারি “ আঠারবাড়ি বিল্ডিং” নামে নিজ নিজ জেলায় পরিচিত। জমিদার বংশের উপাধি ‘রায়’ থেকে পরবর্তীতে উপজেলার অন্যতম প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র রায় বাজারের নামকরণ করা হয়। পরবর্তী জমিদার দীপ রায় চৌধুরী জমিদার পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য যশোর থেকে ১৮টি সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারকে এনে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেন । পরবর্তীতে এই ১৮টি পরিবারের নিবাসকে ঘিরেই এ জায়গাটি আঠারবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। মোট একশ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত জমিদারবাড়ির বিশাল পুকুর, পরিখা, পুকুরে নামার সুড়ঙ্গপথ, বাড়ির দক্ষিণের পুকুরে রাজহাঁস সাঁতার কাটার দৃশ্য অবলোকনের স্থান, চিড়িয়াখানার চিহ্ন প্রায় নেই বললেই চলে । জমিদারবাড়ির নাটমন্দির ও রঙ্গশালায় বছরব্যাপি পূজা-পার্বণ হতো। বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় নাট্যোৎসব ও সংগীতের আসর চলত দীর্ঘদিন ধরে । কলকাতা থেকে নামি দামি শিল্পীরা এসে এখানে উৎসবে যোগ দিতেন । জমিদারের ব্যবহার করা বিশাল আকৃতির সিন্দুক, ময়ূর সিংহাসন ও প্রচুর দর্শনীয় মূর্তির এখন আর কোন স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শান্তি নিকেতনে অধ্যয়ন করেন আঠারবাড়ির সর্বশেষ জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরী । সেই সুবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ওই রায় পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী কবিগুরু আঠারবাড়ি জমিদার বাড়িতে আগমন করেন । জোড়াসাঁকোর জমিদার বাড়ির কুমার কবিকে আঠারবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিশাল মিছিল সহকারে জমিদারবাড়ির নতুন প্রাসাদে নিয়ে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয় । রবীন্দ্রনাথ এ সময় সোনার চাবি দিয়ে নতুন জমিদারবাড়ির দ্বার উন্মোচন করেন। জননন্দিত কথা সাহিত্যিক ও চলচিত্রকার প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ তার গ্রামের বাড়ি ( পার্শ্ববর্তী কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম) থেকে প্রায় ১২ কিলোমিঠার দূরে অবস্থিত এ জমিদারবাড়িতে ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্র সহ বিভিন্ন নাটকের কিছু উল্লেখযোগ্য দৃশ্য ধারণ করেছিলেন । আঠারবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অজয় কিশোর চৌধুরি জানান, বর্তমানে কলেজের আওতায় জমিদারবাড়ির ১১ একর ৪০ শতক সম্পত্তি রয়েছে। ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদ সদস্য জমিদারবাড়িটিকে সংরক্ষণ করার জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরে পত্র প্রেরণ করেছেন। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসাঃ হাফিজা জেসমিন বলেন, ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে জমিদারবাড়ীতে এলাকার গুণিজনদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা শিল্পকলার উদ্যোগে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
© Deshchitro 2024