জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারের (এসিল্যান্ড) 'তদারকি' না থাকায় ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়গুলো অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভূমি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা ভূমিসেবা প্রার্থীদের প্রতিনিয়ত নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। এতে ভেস্তে যাচ্ছে ভূমি মালিকদের জন্য সরকারের গৃহীত নানাবিধ ভূমিসেবা কার্যক্রম। এ বিষয়ে অভিযুক্ত এসিল্যান্ড মুখ না খুললেও তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দাবি, 'ভূমিসেবা প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেব্যাপারে এসিল্যান্ডকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'


উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ জুলাই এসিল্যান্ড পদে মো. আশরাফ আলী ইসলামপুরে যোগদান করেন। এ উপজেলায় সদরসহ ১২টি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় রয়েছে।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসিল্যান্ড পদে মো. আশরাফ আলী এ উপজেলায় যোগদানের পর তাঁর কোনো ধরনের কর্ম তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, উপজেলার শীর্ষ ভূমিকর্তা হিসেবে তাঁর যথাযথ 'তদারকি' না থাকায় ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়গুলো যেনো অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। একের পর এক ভূমি কার্যালয়ে কর্মরত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলছেন ভূমিসেবা প্রার্থীরা।


উপজেলার চরপুটিমারী ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভূমিসেবা দিতে ব্যাপক অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্যের প্রতিবাদে গত ৯ মার্চ স্থানীয় বাসিন্দারা ঝাড়ু মিছিল করেছেন। পরে ভূমিসেবা প্রার্থীদের কাছে ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মমিনুল ইসলামকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তবে অফিস সহায়ক মো. সোহেল রানার ঘুষ বাণিজ্য কিছুতেই থামছে না। দীর্ঘদিন ধরে ওই ভূমি কার্যালয়ে সোহেল রানা কর্মরত। এ সুযোগে ভূমিসেবা প্রার্থীদের কাছ থেকে ভূমি বন্দোবস্ত, নামজারি, পর্চা ও দাখিলা দেওয়ার কথা বলে অন্তত লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।


ইউনিয়নের ডিগ্রিরচর খলিফাপাড়া এলাকার সুলতানের স্ত্রী শুভ বেগম বলেন, 'সোহেল রানা আমাদের জমি বন্দোবস্ত করে দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। এছাড়া আমার দেবর শহিদ মিয়ার কাছে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। টাকা নেওয়ার পরও কাজ না করে দিয়ে গত চার মাস ধরে আমাদের হয়রানি করে আসছে।'


বালিয়ামারির গ্রামের কৃষক ওমর আলী বলেন, 'নামজারিট জন্য সোহেল রানা আমার কাছে ৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে। এখন টালবাহানা করছে। এ বিষয়ে এসিল্যান্ডকে অভিযোগ দিলেও কোনো ফল হয়নি।'


চরপুমিটমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জামাল বেপারী বলেন, 'আমাদের এলাকার কৃষক রাশেদ, একং রুকু মিয়াসহ একাধিক লোকজনের কাছে থেকে অন্তত লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সোহেল রানা।'


অভিযুক্ত সোহেল রানা বলেন, 'আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকেই অভিযোগ দিয়েছে। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।'


চলতি দ্বায়িত্বে থাকা চরপুটিমারী ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'অফিস সহায়ক সোহেল মিয়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শুনানি চলছে।'


নোয়ারপাড়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে ভূমিসেবা দিতে উৎকোচ গ্রহণসহ স্থানীয় হাড়গিলা বাঁধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজে তদারকিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে নোয়ারপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রোমান হাসান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।


ভূমি খারিজ করতে পুতুল রানী নামে সংখ্যালঘু নারীর কাছে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েও কাজটি না করে দেওয়ার অভিযোগ উঠায় ইতিমধ্যে ইসলামপুর সদর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা আইন উদ্দিন ফকিরকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়ে ক্লোজড করেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।


এছাড়া উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের নাজির মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে নামজারি করতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আজগর উদৌলা পাহলোয়ান বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে লিখত অভিযোগ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে নাজির মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করতে জামালপুর জেলা প্রশাসককে (ডিসি) ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ফারুক আহমেদ স্বাক্ষরিত এক পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া নাজির মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি মিস কেস করতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর।


উপজেলার বেনুয়ারচরের কৃষক সুলতান, পৌর শহরের পুতুল রানী, সোনামুখির আবুল হাসেমসহ ভূমিসেবা প্রার্থী অনেকেই বলেন, 'এ্যাসিল্যান্ড আশরাফ আলী যোগদানের পর থেকেই ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়গুলো অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণতি হয়েছে। তার সঠিক তদারকি না থাকায় আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। এ্যাসিল্যান্ডকে লিখিত অভিযোগ দিয়েও আইনানুগ কোনো ধরনের প্রতিকার পাচ্ছি না।'


অভিযুক্ত এসিল্যান্ড আশরাফ আলীর বলেন, 'এ বিষয়ে কথা বলতে ডিসি স্যারের অনুমতি লাগবে। ১০-১২ দিন সময় লাগতে পারে ডিসি স্যারের অনুমতি নিতে। ডিসি স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি কোনো কথা বলতে পারছি না।'


উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মু. তানভীর হাসান রুমান বলেন, 'ভূমিসেবা প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে সেবা পায়, সেব্যাপারে এসিল্যান্ড আশরাফ আলীকে ইতিমধ্যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024