◾ নিউজ ডেস্ক


করোনার সময়ে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এবছর তা তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছেন না। তাই বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এসব মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বড় আকারে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ১২টি ব্যাংক।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধন ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক।


আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমান নিয়মে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি, সেই পরিমাণ অর্থ ন্যূনতম মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এর বাইরে আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকগুলোকে ২০১৬ সাল থেকে অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হচ্ছে। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ন্যূনতম যে মূলধন থাকা প্রয়োজন, তা ১২টি ব্যাংকের নেই।


খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই তাদের মূলধন সংকট চলছে। আর সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও বেশি সুদে তহবিল নিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার ঘাটতিতে পড়েছে। অন্যদিকে অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক।


ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানতের অর্থ থেকে ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে না পারা ও লাগামহীন খেলাপি ঋণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।


নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যাংকের খেলাপি বা মন্দ ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে ততবেশি মূলধন রাখতে হয়।


করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সাল জুড়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ২০২১ সালেও ছিল বিশেষ সুবিধা, কিস্তি পরিশোধে পেয়েছে ছাড়। এব ছর ছাড় উঠে গেছে কিন্তু গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ না করার রেশ কাটেনি এখনও। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকার নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এযাবৎ কালে এটাই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অংক।


তিন মাস আগেও ২০২১ সালের মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চে) বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।


এ ছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এতে মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।


মূলধন ঘাটতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ যত বাড়বে এর বিপরীতে তত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়; এ বাড়তি অর্থ রাখতে গিয়েই ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।


তিনি বলেন, ‘এখন খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে খেলাপি গ্রাহকদের ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ কয়েক বছর ধরে ছাড় পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, খেলাপিরা এখন মনে করছে আমি ঋণ পরিশোধ না করলে আগামীতে আরো ছাড় পাওয়া যাবে। তাই প্রথমে খেলাপিদের ছাড় বন্ধ করতে হবে। আদায় বাড়াতে হবে। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।’


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে বিশেষায়িত খাতের দুইসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ১৭১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঘাটতি বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রণী ব্যাংকে দুই হাজার ৫০৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংকের দুই হাজার ২৭৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের দুই হাজার ২৬১ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ১২৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংকের মূলধন সংকট এক হাজার ৬০৩ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।


বেসরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকের মূলধন সংকট ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৬৫৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা, পদ্মা ব্যাংকের ২৬৩ কোটি এবং বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঘাটতি ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের জুন শে‌ষে ১২টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫৩১ কোটি ৩৫ টাকা। 


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024