|
Date: 2023-06-19 08:45:27 |
আমি কোথায়? আমি এখানে কেন? এই জায়গা তো আমার চেনা নয়।
বিছানায় ধরপর করে উঠে বসে সোনিয়া।
শান্ত হোন প্লিজ। বলছি। আপনি একটু আগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলেন।
আমি আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে আসছি।
আমি রাতুল। একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার।
তা ঠিক আছে কিন্তু আপনি আমাকে কোথায় পেলেন।আর কেনইবা আপনার বাসায় নিয়ে আসলেন?
বলছি তার আগে একটু পানি খেয়ে নিন।এই বলে রাতুল পানির গ্লাসটি সোনিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল আপনার নামটি জানতে পারি?
সোনিয়া।
সুন্দর নাম।
আসলে আমি ধানমন্ডি লেকে প্রকৃতির ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম আপনি এদিক ওদিক দেখে লেকে ঝাপ দিতে যাচ্ছিলেন।
আমি দৌঁড়ে গিয়ে আপনাকে থামাতে গেলে আপনি জ্ঞান হারিয়ে আমার হাতের উপর লুটিয়ে পড়েন।
আমি কি করব বুঝতে না পেরে আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি।
তাই? কই আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
কি বলেন? আপনার কিছুই কি মনে পড়ছে না।
না মনে পড়ছে না। ঠিক বলছি। বিশ্বাস করেন।আসলে আমার একটা রোগ আছে। শর্ট মেমোরি লস। আমি কিছু কিছু ঘটনা ভুলে যাই।
ডাক্তার দেখাননি?
অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কোনো উপকার হচ্ছে না।
আচ্ছা বলুন তো আপনার কিসের এতো কষ্ট? এভাবে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছেন কেন?
আমি আসি আজকে এই বলে সোনিয়া বের হয়ে গেলেন।রাতুলের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।
আজব তো কোনো কথার জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
দূর এজন্য কারো উপকার করা ঠিক না।
রাতুলের মোবাইলটা বেজে উঠলো। তমা কল করেছে।
হ্যাঁলো তমা বল।
এই রাতুল গুলশানের দিকে আসো তো। চলো দুজনে মিলে কফি খাই আড্ডা দিই।
ওকে তমা আধঘন্টার মধ্যে আসছি।
কিরে তমা কতক্ষণ হলো? এই তো দশ মিনিট।
রাতুল কেমন আছ?
ভালো আছি। তবে আজ একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটলো।
তাই? কি বলো?
হুম আমি গুলশান লেকে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম হঠাৎ দেখি একটি মেয়ে এদিকে ওদিক তাকিয়ে লেকে ঝাপ দিচ্ছে। আমি দৌঁড়ে ছুটে যেতেই মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে।কি করব ভেবে না পেয়ে বাসায় এনে শুইয়ে দিলাম।
জ্ঞান ফেরার পর কেমন আগোছালো কথা বলছিল।একসময় হুট করে চলে গেল।
আমার কোনো কথার উত্তর দিল না। বুঝলাম না কি সমস্যা।
তাই? হয়তো ভেতরে তীব্র কষ্ট জমা হয়েছে তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।মেয়েদের কষ্ট তোমরা ছেলেরা কি করে বুঝবে।
রাতুল প্রসঙ্গ পাল্টে বলল যাক বাদ দে তোর কথা বল।কেমন চলছে পড়াশোনা?
ভালো চলছে। আচ্ছা রাতুল তুমি কি আমাকে নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভাবতে পারছ না? নাকি ভাবতে চাইছ না?
তমা অনেকবার বলেছি তোকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবা আমার পক্ষে সহজ নয়।
হুম বলেছ।তারপর ও মন জুড়ে শুধু তোমার স্বপ্ন বুনে যাই আমি।
তুই ভুল করছিস।
ভুল করলে ভুল। আমার ভুলের দায় তো তোমাকে নিতে হচ্ছে না।
তুমি যেদিন কাউকে মন থেকে ভালোবাসবে সেদিন বুঝবে ভালোবেসে ভালোবাসাকে না পাওয়ার কষ্ট।
আমি চাই তুমি কাউকে খুব ভালোবাসো।
তারপর আমার কষ্টটা বুঝবে।
চলো আজ উঠি।
সময় হলে আবার বসবো দুজনে।
হুম।
রাতুল সারারাত ভাবলো সোনিয়ার কথা। কি এমন কষ্ট সোনিয়ার?
সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে পড়লো রাতুল।
বিভিন্ন লোকশনে ছবি তুলে বড্ড ক্লান্ত তাই খাওয়া দাওয়া করার জন্য রেস্তোরাঁয় ঢুকলো।
খাবার অর্ডার করতে গিয়ে খেয়াল করলো দূরে টেবিলে সোনিয়া একাকী বসে আছে।
রাতুল গিয়ে ওই টেবিলে বসলো।আপনি এখানে?
আপনার সাথে আমার দেখা হবে জানতাম তবে এত তাড়াতাড়ি দেখা হবে তা ভাবতে পারিনি।
হুম পৃথিবীতো গোল তাই দেখা হওয়া তো স্বাভাবিক।
আচ্ছা সেদিন ওভাবে চলে এলেন। আপনার বিষয়ে তো কিছু জানা হলো না।
প্লিজ যদি কিছু মনে না করেন তবে বলবেন কেন এতটা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন?
কেন বাঁচালেন? আমি বাঁচতে চাই না সত্যি। রোজ রোজ মরার চেয়ে এই একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
এভাবে কেন বলছেন? এভাবে হারার আগে হেরে যাওয়ার কোনো মানে নেই।
আমার মতো কুৎসিত জীবন হলে আপনি ও আর বাঁচতে চাইতেন না।
ঠিক আছে আপনার সব কথা শুনব তারপর পরামর্শ দিব আপনার কি করা উচিত। অবশ্য আপনি যদি পরামর্শ নিতে চান তবে।
আগামীকাল আমার বাসায় চলে আসুন ঠান্ডা মাথায় বসে সব বিষয় বিস্তারিত শুনব।
আজ উঠি আমার একটা জরুরি কাজ আছে। এই বলে রাতুল বিদায় নিল।
সোনিয়া ভাবছে জীবন তাঁকে ঠিক কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। আদৌ কি সে অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবে?
জানে না সে।কিছুই আর ভাবতে পারছে না।
পরেরদিন রাতুলের বাসায় আসলো সোনিয়া। রাতুল দরজা খুলে হাসিমুখে বলল আসুন।
বসুন। আমি দুকাপ চা করে আনি।
ড্রইং রুমে বসলো সোনিয়া। এরমধ্যে রাতুল চা নিয়ে হাজির।
তারপর বলুন কেমন আছেন?
আর থাকা।যে মানুষটি বেঁচে থেকেও রোজ মরছে সে কিভাবে ভালো থাকবে বলতে পারেন?
বিষয়টি খুব জটিল।
আচ্ছা বলুন তো শুনি আপনার জীবনগল্পটা।
আমার বয়স যখন দশ বছর তখন মা মারা যায় ক্যান্সারে। সাত বছর বয়সী ছোট ভাই ছিল। এ অবস্থায় মা মারা যাওয়ার সাত মাসের মাথায় বাবা বিয়ে করে আবার।
ছোট ভাইকে একদম সহ্য করতে পারতেন না সৎ মা খুব মারধর করতেন। আমি এসব বাবাকে বললে তিনি বিশ্বাস করতেন না।
আমি এসএসসি পাশ করার পর দু একটা টিউশন করতাম।
কোনো ভাবে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা আমাদের খোঁজ রাখতেন না তেমন। একদিন আমি কলেজ থেকে আসার পর দেখি একজন বয়স্ক লোক ড্রইং রুমে বসে সৎ মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে খুব হাসাহাসি করছে।
আমাকে বলল চা করে আনতে। আমি চা করে দিলাম।
কয়েকদিন পর জানলাম ওই লোকের সাথে আমাকে বিয়ে দিবে কারণ তাঁর অনেক টাকা।
আমার কোনো আপত্তি কাটলো না। নিজের জীবনের কথা বাদ দিয়ে দুটি শর্ত দিলাম। আমার ছোট ভাই কে পড়ালেখা করাতে হবে শেষপর্যন্ত। আর একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে এই শর্ত মেনে আসিফ সাহেব আমাকে বিয়ে করতে রাজী হলেন।
আমাকে বিয়ে করে ঢাকা নিয়ে আসলো। টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। এক কথায় কোনো কিছুর অভাব নেই। অভাব শুধু ভালোবাসার। টাকা ছাড়া মানুষটা কিছু বুঝে না।বিয়ের এখন দু'বছর বছর গত হলো।
কিন্তু আজ পর্যন্ত ও আমি স্বামীর ভালোবাসা কি বুঝতে পারলাম না।
ছোটবেলা থেকে কষ্টে বেড়ে ওঠা এই আমি কত স্বপ্ন বুনেছি স্বামীর ঘরে গিয়ে হলেও একদিন সুখ পাব।
কিন্তু কি হলো? কি পেলাম আমি বলতে পারেন?
আমার স্বামীর একমাত্র চাওয়া প্রতি বৃহস্পতিবার তার ব্যবসায়ী পার্টনারদের সাথে মিটিং হবে সেখানে সাজগোছ করে আসিফ সাহেবের স্ত্রী হিসেবে উপস্থিত থাকতে হবে গভীর রাত অবধি। তাদের মদের নেশার লোলুপ দৃষ্টি আমাকে হযম করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। তাদের ডান্স করার মন হলে ডান্স করতে হবে। তাদের আরো চাহিদা থাকলে সেগুলো পূরণ করতে হবে। এতে নাকি তাঁর বিজনেস পেতে সুবিধা।
কিন্তু বলুন এভাবে রোজ রোজ আর কতবার মরব আমি? তাই একবারে মরতে গেছিলাম। আপনি কেন বাঁচালেন?
কথাগুলো বলার পর হু হু করে কেঁদে উঠলো সোনিয়া।
রাতুল নির্বাক।সত্যি মানুষের জীবনে এত জটিলতম কিছু থাকতে পারে এ বিষয়ে কোনো ধারনা ছিল না তার।
প্লিজ শান্ত হোন।এভাবে কাঁদবেন না। আপনার নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।
এভাবে কি বাঁচা যায়? আপনি বলুন।
বাঁচা যায়। আপনাকে সাহসী আর প্রতিবাদী হতে হবে।
আমি পারব?
কেন পারবেন না।নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। জীবন টা হেরে যাওয়ার জন্য নয়।লড়াই করে টিকে থাকার নাম জীবন।
প্রায় ফোনে কথা হয় রাতুল আর সোনিয়ার। সারাক্ষণ এসএমএস এ কথা হয় দু-জনের। এভাবে চলছে।
সোনিয়া একদিন রাতুলকে বলল আজকে তোমার বাসায় দেখা করতে চাই।
আসিফ বলল ঠিক আছে সকাল সাড়ে এগারটার দিকে চলে আস।
রাতুল আর সোনিয়া নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছে হঠাৎ সোনিয়া বলল আমি আসিফ সাহেবকে ডিভোর্স দিতে চাই। রোজ আর এভাবে থাকা আমার জন্য অসহ্য।
রাতুল সোনিয়ার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল।
খুব ভালো এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ।
কিন্তু রাতুল আমার ভাইটার কি হবে?
কি হবে তুমি যা ভেবেছ তাই হবে। আমি আছি তো কেন এতটা ভাবছ।
রাতুল তুমি পারবে তো আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে।আমি একটু ভালোবাসা চাই।একটু সুখ চাই। আমার জন্য কেউ খুব ভাবুক সেটা চাই। তুমি আমার এসব চাওয়া পূরণ করতে পারবে তো?
বুকে জড়িয়ে নিল রাতুল সোনিয়াকে। অনুভব করো তুমি এই বুকে তোমার জায়গা কোথায়। কতটা ভালোবাসি তোমাকে। তোমার বসন্ত দিনে আমি হবো তোমার চলার পথের সাথী।
এতটুকু কষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে দিব না তুমি দেখো।
সোনিয়া হু হু করে কেঁদে উঠলো। এতটা সুখ কি আমার কপালে আছে রাতুল।
আরে পাগলী কেন কাঁদছ। তোমার রাতুল হয়তো ততটা ঐশ্বর্য দিতে পারবে না কিন্তু সাবলীল সুখে ভরিয়ে রাখতে পারবে তোমাকে অনন্তকাল।
চোখ মুছে দিয়ে বলল আর কখনো এচোখ জলে ভরবে না।
সোনিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল আজ তাহলে ফিরি।
খুব শীঘ্রই আমাদের একসাথে পথচলা শুরু হবে।
আসিফ সাহেব ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর যাবে তাই বেশ তড়িঘড়ি করে লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছে।
সোনিয়া চা নিয়ে রুমে আসলো। বলল তুমি কি এখনি বেরুবে?
আসিফ সাহেব বলল হুম।কেন কিছু বলবে? তোমার একাউন্টে হাতখরচের টাকা পৌঁছে গেছে চেক করে নিও।আরো লাগলে বলো ট্রান্সফার করে দিব।
সোনিয়া খুব বিরক্ত হয়ে বলল আচ্ছা তোমার কাছে কি টাকা ছাড়া কোনো কথা নেই?
আর কি কথা থাকতে পারে বলো।
সোনিয়া খামটা এগিয়ে দিয়ে বলল এটা পড়ে দেখো।
আমি ডিভোর্স চাই।
আসিফ সাহেব খুব শান্ত গলায় বলল তোমার শর্ত তাহলে কি হবে?
আমার কোনো শর্ত তোমাকে পূরণ করতে হবেে না।
সোনিয়া ভেবে বলছ তো?
হুম ভেবে বলছি।
ঠিক আছে এক সপ্তাহ পর ফিরে এ বিষয়ে ফাইনাল করছি এই বলে আসিফ সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
সোনিয়া ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কি অদ্ভুত আচরণ মানুষটার। সম্পর্ক থাকুক কিংবা ভেঙে যাক তার যেন কিছুই এসে যায় না। টাকা তার কাছে মূল বিষয়। আমি সোনিয়া চলে গেলে হয়তো গরীব ঘরের অন্য কোনো সুন্দরী সোনিয়াকে খুঁজে নিয়ে বিয়ে করবে। তাকে দিয়ে বিজনেস বাড়াবে।ছিঃ ছিঃ কি জঘন্য মানুষের সাথে এতদিন দিন কাটিয়েছে ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। যার কাছে মানুষের কোনো মূল্য নেই কেন থাকবে তার সাথে।মনকে শক্ত করে নিল সোনিয়া। তাকে বাঁচতে হবে নিজের মতো করে।
এক সপ্তাহ পর ফিরল আসিফ সাহেব। ডিভোর্সের সব কিছু ফাইনাল হতে মাস তিনেক সময় লাগলো।
রাতুলের কাছে চলে আসলো সোনিয়া। ছোটভাই শিহাবকে নিয়ে আসলো রাতুল তাদের কাছে।
সোনিয়া নিজেকে মুক্ত করার সুখে হাসছে।রাতুল সোনিয়াকে পেয়ে নিজেকে বড্ড সুখী ভাবছে।
রাতুল তোমাকে না পেলে আমি সত্যি নিজেকে শেষ করে দিতাম।তুমি আমাকে জীবনের বসন্ত রঙিন দিনের সন্ধান দিয়েছ। আজ আমি বড় সুখী তোমার ভালোবাসা পেয়ে। এই ভালোবাসার হাহাকার ছিল আমার হৃদয় জুড়ে। রাতুল তুমি মৃতপ্রায় মানুষটিকে নতুন জীবন দিলে।আবার স্বপ্নরঙিন পৃথিবীতে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেলাম তোমার থেকে।
আমি সবসময় তোমার সাথে আছি পাশে আছি সোনিয়া।তুমি মনের আনন্দে বাঁচো।
শপথ নিল দু'জনের কেউই আর পেছনে ফিরে দেখবে না সুন্দর আগামীর পথে এগিয়ে যাবে ভালোবাসার দৃঢ় বিশ্বাসে।।
লেখক : প্রণব মন্ডল, কবি & শিক্ষার্থী ; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
© Deshchitro 2024