|
Date: 2022-09-12 00:05:51 |
◾ আরাফাত শাহীন
যদি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়—সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ কে? যারা নিজেদের ন্যূনতম মুসলিম হিসেবে দাবি করেন, তারা একবাক্যে উত্তর দেবেন—মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অমুসলিমরা প্রথম দিকে হয়ত একটু চিন্তায় পড়ে যাবে। কিন্তু তাদের সামনে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষ্কলুষ ও পবিত্র জীবন উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, তখন তারাও এই সত্যটি মেনে নিতে বাধ্য হবে। এজন্যই পাশ্চাত্যের বিখ্যাত লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার 'The Hundreds' বইয়ে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ১০০ মনীষীর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে রাসূলে আরাবিকে সবার প্রথমে স্থান দিয়েছেন। তাছাড়া পশ্চিমা লেখক ও ঐতিহাসিকেরা যতই তাঁর সমালোচনায় মুখর থাকুন না কেন—দিনশেষে তারাও নবীজির জীবনের পবিত্রতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আল্লাহর রাসূলের চরিত্রের কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, যার মোহে গোটা দুনিয়ার মানুষ গত চৌদ্দশো বছর ধরে মোহিত হয়ে আছে?
একজন মানুষ আরবের ধূসর মরুভূমিতে এমন সময় জন্ম নিলেন—যখন চারিদিকে অন্যায় আর অসভ্যতা মাকড়সার জালের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। আরবের সেই পঙ্কিল পরিবেশ—যেখানে শিরক আর কু*ফরে লিপ্ত ছিল গোটা জনপদ, সেখানে থেকেও তিনি নিজেকে পুরোপুরি পবিত্র রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর জবান দিয়ে কখনও কোনো মিথ্যা শব্দ বের হয়নি, কখনও কোনো অশ্লীল শব্দও শোনা যায়নি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর লজ্জাশীলতা ছিল প্রবাদের মতো। অথচ সে সময় আরবে নির্লজ্জতা আর বেহায়াপনার জোয়ার বইছিল। নবীজি কখনও অপ্রয়োজনে কাউকে আঘাত করেননি। কাউকে হ*ত্যা করেননি তিনি। অবশ্য উহুদের ময়দানে তাঁর হাতে থাকা বর্শার খোঁচায় আহত হয় উবাই ইবনে খালফ। পরে সেই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়। [১] তবে যু*দ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন বীর বাহাদুর। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যু*দ্ধ করতে পারে এমন কেউ ছিল না।
সেই অন্ধকার যুগেই তিনি তাঁর অপূর্ব চরিত্রমাধূর্য দিয়ে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বেই তিনি 'আল-আমিন' (বিশ্বস্ত, আমানতদার) হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। [২] আর এটা হবেই-বা না কেন! শৈশবেই মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর ক্বলবকে ফেরেশতার মাধ্যমে পবিত্র পানি দিয়ে ধৌত করে দিয়েছিলেন। [৩] ফলে সে হৃদয়ে কোনো পঙ্কিলতা মুহূর্তের জন্যও প্রবেশ করতে পারেনি।
তাঁর চেয়ে কোমল স্বভাবের, মহৎ হৃদয়ের মানুষ এই পৃথিবী আর জন্ম দেয়নি। তিনি তাঁর ঘোরতর শত্রুকেও ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিতে সক্ষম ছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় চলে যাচ্ছিলেন, তখন কুরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে সুরাকা বিন মালিক নামক এক যুবক তাদের ধরে ফেলেছিলেন। চাইলে তিনি সুরাকাকে হ*ত্যা করতে পারতেন। কারণ, সে ছিল শ*ত্রু। কিন্তু তা করেননি। বরং সুরাকার জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছেন। [৪]
আপনি পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানুষ কোথায় পাবেন—যাঁকে নির্মমভাবে নির্যা*তন করার পরও তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন! তায়েফের নির্যা*তনকারীদের ধ্বং*স করার সুযোগ পেয়েও তিনি তাদের জন্য দোয়া করে বলেছেন—হয়ত এদের পরবর্তী বংশধর এক আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না! [৬]
তাঁকে হ*ত্যা করতে তর*বারি ওঠানো মানুষটিকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন কোনোকিছু চিন্তাভাবনা না করেই। জি, এমনই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতা।
যে কুরাইশরা তাঁকে জন্মভূমি মক্কার মাটি থেকে বহিষ্কার করেছে, এমন কোনো নির্যা*তন নেই যা করেনি, আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করতে বাঁধা দিয়েছে, তাদের তিনি কী করলেন মক্কা বিজয়ের পর? ভয়ে জবুথবু হয়ে যাওয়া কুরাইশদের তিনি জানিয়ে দিলেন—আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করা হলো। অথচ চাইলেই তিনি প্রতি*শোধ নিতে পারতেন। দয়ার নবীজি প্রতি*শোধের চেয়ে ক্ষমাকেই বেছে নিলেন। [৬]
তিনি এমন মানুষ ছিলেন—জগতের সকল মানুষই যাঁর কাছে এসে আশ্রয় ও সম্মান লাভ করতো। তিনি সবাইকে অতি সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। এজন্যই একজন গ্রাম্য বেদুইনকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতেন অবলীলায়। ইহু-দির জানাজায় দাঁড়িয়ে গিয়ে সাহাবিদের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারতেন—সে কি একজন মানুষ নয়? [৭]
কেউ কখনও তাঁর দুয়ারে এসে ফিরে যেতো না। সেটা হলে বিশ্বনবীর জন্যই অপমানজনক হতো। যাঁর ঘরে দিনের পর দিন চুলো জ্বলেনি; শুধুমাত্র খেজুর আর পানি খেয়ে দিন কেটেছে পুরো পরিবারের, সেই তিনিই দু-হাতে অকাতরে দান করতেন। নিজের জন্য পছন্দ করা ও অতি প্রয়োজনীয় চাদরটিও একজন সহজ সরল সাহাবিকে দিয়ে দিতে পারতেন। [৮]
আপনি এমন মানুষ কোথায় পাবেন? পারবেন পুরো দুনিয়া খুঁজে একজন বের করতে?
সুতরাং কবির কলম থেকে অবলীলায় বের হয়ে আসে—
"বালাগাল উলা বি কামালিহি
কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি
হাসানাতু জামিউ খিয়ালিসি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি..." [৯]
আর মহান আল্লাহ তাআ'লা নিজে যাঁর চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন, সারা দুনিয়ার মানুষ মিলেও কি তার কিছু হেরফের করতে পারবে?
وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
'নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।' [১০]
অগণিত দুরুদ ও সালাম প্রাণপ্রিয় নবীজির ওপর।
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
© Deshchitro 2024