|
Date: 2023-07-22 11:00:45 |
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া ৩৪টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা এখন চরম হতাশার মধ্যে বসবাস করছে। কারণ রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়াতে তাদের মধ্যে হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এর ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তা জনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।মূলত মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশনের (আরএসও) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধী।
সূত্রে জানা গেছে,প্রত্যাবাসন না হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা, আরএসও ও নবী হোসেন গ্রুপের ব্যাপক অপতৎপরতা বেড়েছে। বর্তমানে ক্যাম্প কেন্দ্রিক অস্ত্র-মাদক ব্যবসা,মানবপাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই তাদের মূল টার্গেট। ক্যাম্পে এ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্যের কারণে খুনোখুনি বাড়ছে। টেকনাফ ও উখিয়ার ওই ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে পাঁচ বছরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৭৩টি।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আরসার তাণ্ডবে দিশাহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পুরোনো আরসার সদস্যরা নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।
শুক্রবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আরসার ভারপ্রাপ্ত সামরিক কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫)।
র্যাব জানায়, নূরের বিরুদ্ধে ১৫টি হত্যা মামলা রয়েছে। তাকে আটকের সময় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১টি ৭.৬৫ এম,এম পিস্তল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ১টি শর্টগান, ৪টি দেশীয় এলজি, ৩টি রামদা ও গোলাবারুদসহ নগদ ৭০হাজার টাকা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনতিনি জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে। আরসার একটি আস্তানায় অভিযান চালানোর পর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদ ও তার সহযোগীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।তারা হলেন, হোসেন জোহার, ফারুক, মনির আহাম্মদ, নূর ইসলাম, ইয়াছিন। এরা সকলেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাগরিক।
র্যাব সূত্র জানায়, আরসা নেতা হাফেজ নূর মোহাম্মদের (২৯) বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও অপহরণ, বোমা বিস্ফোরণ ও বোমা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০১৬ সালে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আরসার ওই সময়ের সামরিক প্রধান ওস্তাদ খালেদের কাছ থেকে অস্ত্র, রণকৌশল প্রশিক্ষণ নেন। আরিফ উদ্দিন ওরফে হাসেম ওরফে কুইল্লা ওরফে আসাদ ভাইয়ের কাছ থেকে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৭ সালে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার পর টার্গেট কিলিংয়ে নামেন আরসার ভয়ংকর এ সদস্য হাফেজ নূর মোহাম্মদ। তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ৮-এর ইস্ট এবং ওয়েস্ট ময়দানি শাখার প্রধান।তার অধীনে রয়েছে ৩০-৩৫ জন সদস্য। তাদের অন্যতম কমান্ডার আবদুল হাকিম দায়িত্ব পালন করলেও তিনি নামে মাত্র কমান্ডার।
এ ছাড়াও তাদের মধ্যে রয়েছে নূর আহাম্মদ, মোহাম্মদ ইউসুফ(মিয়ানমারের সাবেক সেনাসদস্য),আক্তার হোসেন, মনজুর আলম। হাফেজ কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া এবং বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ওয়ান শুটারগান, ৭.৬৫ মি.মি পিস্তল,রামদা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র। তার কাছেই রয়েছে ১৯টি অস্ত্র।মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপকে অস্ত্র সরবরাহ করতেন তিনি।অস্ত্র সরবরাহ করতেন তিনি।
কে এই হাফেজ নূর মোহাম্মদ :
কুরআনের হাফেজ হওয়ায় তার নামকরণ হয় হাফেজ নূর মোহাম্মদতার বাবার নাম মৃত দিল মোহাম্মদ। বিয়ে করেছেন দুটিপ্রথম স্ত্রীর নাম নূর ফাতেমা ও দ্বিতীয় স্ত্রী হাসিনা বেগম। হাসিনা বেগম বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে চার সন্তান। তাদের মধ্যে দুই ছেলে ও দুই কন্যা। মূলত তিনি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক। তার জন্মস্থান মিয়ানমারের লুডাংয়ের মংডুর ৫ নম্বর সেক্টরবর্তমান অবস্থান বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ক্যাম্প-৮-এর ১৭ নম্বর ব্লক- বি। তার পরিচিতি নম্বর এফসিএন-১২৮৯১৩।
২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বদ্দারহাটে অবস্থান করেনএরপর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর থাকেন কেরানীহাটে। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে থাকেন দোহাজারী। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত থাকেন খুঁটাখালী এলাকায়। এক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮-এর হেড জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান
র্যাব সূত্র জানায়, হাফেজ নূর মোহাম্মদ ২০১৬ সালে আরসায় যোগদানের পরেই সেকশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ৮-ইস্ট এবং ৮-ওয়েস্টের আরসার কমান্ডার হিসেবে আবদুল হাকিম নিয়োজিত থাকলেও মূলত গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছেন হাফেজ নূর মোহাম্মদ। তার গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন সময় অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, মুক্তিপণ না পেলে ভিকটিমকে খুন করে লাশ গুম করা প্রতিদিনের ঘটনা।
সাধারণ রোহিঙ্গারা কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে অথবা অপহরণ করে লাশ গুম করে ফেলে। হাফেজ নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় ৪টি হত্যা মামলা, ২টি অস্ত্র মামলা, ১টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধাদানের মামলা, ১টি অপহরণ ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় ২টি হত্যা চেষ্টা মামলাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বাজার সংলগ্ন কোনারপাড়া এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রেজোয়ান হত্যা ও র্যাব সদস্য কনস্টেবল সোহেল হত্যার চেষ্টার মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর ক্যাম্প-৮ (ইস্ট) হেডমাঝি শফিউল্লাহকে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। একজন মহিলার কাছে তিনি আশ্রয় চাইলে মহিলাটি তাকে আশ্রয় দেবে না বললে তাকে গুলি করে হত্যা করে। আরসাবিরোধী কথা বলায় মো. সালাম নামে একজন রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত সিক্স মার্ডারের নেতৃত্ব এবং চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি আরসাবিরোধী সদস্য মো. সলিম হত্যা, ক্যাম্প-৮ (ইস্ট) বাসিন্দা মো. মালেক হত্যাক্যাম্প-৮ (ইস্ট) বাসিন্দা মো. হাবুইয়াকে গুলি করে হত্যা একই ক্যাম্পের মো. ইমান হোসেন, মো. আবুল মনসুর হত্যা, মো. সালেহ হত্যা, ক্যাম্প- ৬-এর বাসিন্দা মো. কামালকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা ও ক্যাম্প-৮-এর মো. রফিককে গুলি করে আহত করার অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়াও গত ৬ জানুয়ারি তার গ্রুপের সঙ্গে আরএসও গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে মো. নবীর পায়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার ঘরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। পরে এপিবিএন পুলিশ অবিস্ফোরিত অবস্থায় গ্রেনেডটি উদ্ধার করে ।
ফারুক ওরফে হারেস :
মো. ফারুক ওরফে হারেস (২৩)পিতার নাম ওবায়দুর রহমান। তিনি মিয়ানমারের বাস্তচ্যুত নাগরিক। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসে ২০১৮ সালে আরসায় যোগ দেন। তিনি আরসা প্রহরী দলের প্রধান সমন্বয়কারী। তার প্রহরী দলে রয়েছে ১০ জন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৫ অভ্যন্তরে মাস্টার শোয়াইবের মাধ্যমে কুংফুর প্রশিক্ষণ নেন। তার কমান্ডার মাস্টার সলিম ও শাহ আলম। শাহ আলম আরসার গ্রুপ কমান্ডার। বড় ভাই শাহ আলমের নির্দেশে ১৫ জনের একটি দল স্থানীয় দোকানপাট থেকে ৫০০-১০০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে। অপহৃত ব্যক্তিদের টর্চার করার জন্য টর্চার সেল’ মনিটরিং করেন ফারুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৫ অধীনে ১০ জনের একটি ‘নেট গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপটি ক্যাম্পের বিভিন্ন গোপন স্থানে রাত জেগে গুপ্ত প্রশাসন ও শত্রুপক্ষের অবস্থান পর্যবেক্ষণ এবং রিপোর্ট করতেন ফারুক।
মনির আহাম্মদ :
ক্যাম্প-১৬-এর বাসিন্দা মনির আহাম্মদের (৩৬) পিতার নাম জমলুক। তিনি মিয়ানমার থেকে আরসায় যোগ দেন ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে এসে আরসার হয়ে ওই ক্যাম্পের মাসিক চাঁদা তোলার কাজ করেন। আরসার সন্ত্রাসী গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য মনিরের কাজ সদস্যদের তথ্য সরবরাহ করা। তার দলেও রয়েছে ৭-৮ জন। অস্ত্র পরিচালনায় দক্ষ, শাওলিন কুংফুর ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কমান্ডার মৌলভী রিয়াজুল আমিন এবং সলিমের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। তার কাজ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারী, অস্ত্র পরিচালনা ও মাদক পাচার।
হোসেন জোহার :
পুরো নাম মো. হোসেন জোহার (৩০)। তার পিতার নাম ধলা মিয়া। বিবাহিত এবং তিন ছেলের বাবা তিনি। আরসা এই সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও ক্যাম্প-১৫ জামতলী ৭-এর ‘এইচ’ ব্লক তার নিয়ন্ত্রণেতিনি আরসার হয়ে টার্গেট কিলিং, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের কাজ করেন। ২০১৬ সালে আরসার তৃণমূল সদস্য হিসেবে যোগ দেন।তিনি ‘সি’ ব্লকের হেডমাঝি আবু তালেবকে গুলি করে হত্যা,সাবমাঝি সৈয়দ হোছনকে গুলি করে ও চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা, ‘ই’ ব্লকে শফিকুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করেন।
নূর ইসলাম :
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা সদস্য ও আরসার অন্যতম সদস্য নূর ইসলাম (২৯) কুখ্যাত সন্ত্রাসী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারী, মাদক ব্যবসায়ী। ২০১৬ সালে আরসায় যোগ দেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে আসার পর আরসার দায়িত্ব পালন করেন ক্যাম্প-১৬। তার বিরুদ্ধে মাসিক চাঁদা আদায়, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযোহগ রয়েছে। তিনি ওই ক্যাম্পের আরসার প্রহরী দলের একজন সক্রিয় সদস্য। তার দলেও রয়েছে ৮-১০ জন। তিনি টানা এ ক বছর আরসার সন্ত্রাসী গ্রুপের মাধ্যমে অস্ত্র পরিচালনার ট্রেনিং নিয়েছেন।
মো. ইয়াছিন :
মো. ইয়াছিনের (২১) পিতার নাম হোসেন। ব্লক-সি/১, ক্যাম্প-১৬ আরসার নিরাপত্তা পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১৭ সালে আরসায় যোগ দেন। বাংলাদেশে আসেন ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। তার প্রহরী দলে রয়েছে ১০-১২ জন। অস্ত্র পরিচালনায় তিনি দক্ষ। কমান্ডার মৌলভী রিয়াজুল আমিন এবং সলিমের কাছে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
উল্লেখ্য ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনদের বর্বরতা ও নির্মমতার শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ওই বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। এছাড়া মিয়ানমারে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া ১২ লাখ। তারা উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দোসর আরসা তাদের উপর নিয়মিত-অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
© Deshchitro 2024