◾মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ


আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য তিনি তাঁকে মহাবিশ্বের সব বস্তুর নাম ও বৈশিষ্ট্যের জ্ঞান দিয়েছেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেননি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ আদমকে সব নাম শিক্ষা দিলেন।’ (সুরা বাকারা: ৩১) মুফাসসিরগণ বলেন, আয়াতে ‘সব নাম’ বলে সৃষ্টিজগতের সব বস্তুর পরিচয়, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন) 


হজরত আদম (আ.)-কে শেখানো সব জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা তাঁর সন্তানদের মধ্যে জিনগতভাবে বিদ্যমান। তবে চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে। যেহেতু স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করতে হলে এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের খুবই প্রয়োজন, তাই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। 


মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকজনের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃজনপ্রক্রিয়া নিয়ে এবং বলে, হে আমাদের রব, এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৯০-১৯১) 


অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, যা মানুষের উপকারে আসে তাতেসহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেন তাতে আর তার মধ্যে যাবতীয় জীবজন্তুর বিচরণে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানী জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা: ১৬৪)


এ ধরনের আরও অনেক আয়াতে মহান আল্লাহ বিজ্ঞানগবেষণার বিভিন্ন উৎসের সন্ধান দিয়েছেন এবং মানুষকে এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন মহাবিশ্বের সব গ্রহ-নক্ষত্র পরস্পর মিলিত ছিল এবং পানি থেকেই যে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের উদ্ভব—এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে আকাশসমূহ ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে, এরপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং প্রাণ আছে এমন সবকিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে; তবু কি তারা ইমান আনবে না?’ (সুরা আম্বিয়া: ৩০) 


রাসুল (সা.) বিজ্ঞানচর্চার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এরশাদ করেন, ‘জ্ঞানভিত্তিক কথা মুমিনের হারানো ধন। সুতরাং মুমিন যেখানেই তা পাবে, সে-ই হবে তার অধিকারী।’ (ইবনে মাজাহ) কোরআন ও হাদিসে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার প্রতি গুরুত্বারোপ করার কারণে ইসলামের সব আলিম ও ফকিহ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে গণিত, পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নির্মাণবিদ্যাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব শাখা-উপশাখা পৃথিবী ও মানুষের জন্য কল্যাণকর, তা শেখা, চর্চা ও গবেষণা করা ফরজে কিফায়া। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন)


ইসলামে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি এমন গুরুত্বারোপের ফলেই দেখা যায়, সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ, রসায়ন, খনিজবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ, গণিত, মহাশূন্যে গবেষণাসহ বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। আব্বাসি খলিফা মামুনুর রশিদ বাগদাদে ‘বায়তুল হিকমা’ নামে একটি বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপীয় সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনের ফলে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানকে ছোট করে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি হলেও জাবির বিন হাইয়ান, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, আবু জায়েদ, আল খাওয়ারিজমি, ইবনে বাজ্জা, আল বেরুনি, বাত্তানি প্রমুখ মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম এবং তাঁদের অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। 


লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2023