বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বেশ বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে। দীর্ঘসময় ধরে একস্থানে অবস্থানের কারণে তারা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। এতে করে জনজীবন দুঃসহ হয়ে ওঠা স্থানীয়রা নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। আজ ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়ার ষষ্ঠ বছর পূর্ণ হচ্ছে।


কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে স্থানীয় আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীকে। প্রায় সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘটছে খুন, অপহরণ, গুম, অসামাজিক কার্যকলাপ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক বেচাকেনা। শত শত রোহিঙ্গা সস্তায় শ্রম বিক্রি করায় স্থানীয় দরিদ্ররা আর্থসামাজিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই ক্যাম্পের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিশ্চিত করা এবং ক্যাম্প থেকে বাইরে আসা–যাওয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।


গত ছয় বছরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা গুরুতর নানা অপরাধের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ওপরও একাধিক সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত ৬ বছরে আশ্রিত ৬ হাজার ৮৩৭ জন রোহিঙ্গা অপরাধীর বিরুদ্ধে তিন হাজারের মত মামলা রুজু হয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৭ টি মামলা হয়েছে মাদক পাচার সংক্রান্ত। অন্যান্য মামলার মধ্যে ২৩৮ টি অস্ত্র আইনে, ৯৪ টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টা, ৪৪ টি অপহরণ, ২৪৩ টি হত্যা মামলা, ৩৭ টি মানব পাচার, ৬২ টি ডাকাতি মামলা, ৪২ বৈদেশিক আইনে এবং ৬৫ টি বিশেষ ক্ষমতা আইনে। একই সময়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে দায়িত্বরত পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭ টি।


কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন পুলিশের তিনটি ব্যাটলিয়ন সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের কিছু রয়েছে খুব ভয়ংকর। এরা অপহরণ, হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, মাদকপাচার ও ব্যবসা, ধর্ষণ, গ্যাং গ্রুপ সহ উল্লেখযোগ্য ১৪ ধরনের গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত।


উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বাজারের স্থানীয় মুদি দোকানদার আবদুর রহমান জানান, এ বাজারে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত হাজার দেড়েক বিভিন্নরকমের দোকান আছে। এসব দোকানের ৮০ ভাগ ব্যবসা করছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। তারা রীতিমতো লক্ষ লক্ষ টাকা সেলামি ও মাসিক ভাড়া দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেয়। এখানে বাংলাদেশীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুব কম। ক্রেতাদের অধিকাংশও রোহিঙ্গা। তারা বাংলাদেশীদের দোকান থেকে তেমন কেনাকাটা করে না।


অপর ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ বাজারের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা অবৈধ ও অনৈতিক লেনদেনের যোগাযোগের জন্য চেম্বার হিসেবে দোকান নিয়েছে। হুন্ডি, মাদক, স্বর্ণ, মানব, ডলার পাচারসহ নানা অনৈতিক কাজই তাদের আসল ব্যবসা। বিভিন্ন মনোহরী, মুদি, মোবাইল ফোন, ওষুধের দোকান, চাল, ডাল ও অন্যান্য কাঁচা পণ্যের আড়তও অধিকাংশ রোহিঙ্গার নিয়ন্ত্রণে।


বালুখালী পানবাজার এলাকার ইজিবাইক চালক শহীদুল আলম জানান, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং, উনছিপ্রাং, আলীখালী, লেদা, নয়াপাড়া, মোচনীসহ কক্সবাজার – টেকনাফ সড়কের বিরাট একটা অংশ জুড়ে শত শত ইজিবাইক চালাচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। তাদের কারণে এ সড়কে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে যেসব ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা চলে এর প্রায় চালক ও মালিক রোহিঙ্গারা। উখিয়া ও টেকনাফেরে সড়কের ক্ষুদ্র বাহনগুলো, চা দোকানের বয়, পাড়া গ্রামের সবধরনের শ্রম কাজ বর্তমানে রোহিঙ্গাদের দখলে।


সুজনের উখিয়া সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে বার বার বলে আসছি এভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণহীন করে রাখা সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ক্রমশঃ হুমকি। এ এলাকায় যেসব অপহরণ ও অঘটন ঘটছে সবের পিছনে রোহিঙ্গারা জড়িত।


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানে উদ্বিগ্ন। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয় কিছু লোক নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের অবস্থান আরেকটু দীর্ঘ হলে তারা এখানকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে।


স্বাধীন বাংলাদেশের ভূ–খণ্ডে ১৯৭৮ সালে প্রথম অনুপ্রবেশ শুরু করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা। সেই থেকে কয়েকবছর পর পর নানা বাহনা সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের পর থেকে বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ সামরিক দমন–পীড়নের মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।


এদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈদেশিক অর্থ মিলছে না। তহবিল সংকটের কারণে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাসিক খাদ্য সহায়তা জনপ্রতি ১২ ডলার থেকে দুই দফায় কমিয়ে ৮ ডলার করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। জাতিসংঘের এই সংস্থা যদিও বলেছে, খাদ্য সহায়তার এ ঘাটতি বাংলাদেশকেই পূরণ করতে হবে। এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ।


রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমানোর ফলে আশ্রয় শিবিরগুলোতে অস্থিরতা ও বিশৃক্সখলা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাঁর মতে, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র চোরাচালান এবং অসামাজিক কার্যকলাপ বাড়বে। খাবারের অভাবে ক্যাম্পে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। স্থানীয় দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের আয়ের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকার কথা জানান তিনি। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হবে।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যদিও বাংলাদেশ ও জাতিসংঘসহ দাতাগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ওরা চায় রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে। শরণার্থী ঘোষণা দেয়ার পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেক দায় এসে পড়বে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ ও জনগণ নীতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।


বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ এর প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী নয়। যদিও তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক অদূরদর্শীতায় শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসাবে ১৯৯২ সালের আগে আসা রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয়। এর পরে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর পরিবর্তে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।


রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ষষ্ঠ বছর পূর্তির প্রাক্কালে বুধবার (২৩/০৮/২০২৩ ইং) চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে গমনাগমন রোধে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি নুরে আলম মিনা, কক্সবাজারের ডিসি, এসপিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024