|
Date: 2023-09-05 10:28:46 |
শংকরীর জলবায়ু সহনশীল কৃষি খামার
রনজিৎ বর্মন শ্যামনগর উপজেলা প্রতিনিধি ঃ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিকাজে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কাজ করেন। যুগে যুগে নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ ও সংরক্ষনের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে প্রাণবৈচিত্র্য এবং আমাদের খাদ্য ভান্ডার। সেই সাথে প্রাণবৈচিত্র্যের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। এক সময় উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের প্রতিটি কৃষি বাড়ীই ছিল এক একটি খামার। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের রুপ/আকার পরিবর্তন করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ একটি কৃষি বাড়ী/খামার তৈরী করতো। কিন্তু,আধুনিক কৃষির প্রচলন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বাণিজ্যিক চিংড়ী ও কাঁকড়া চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের অসংখ্য কৃষি পরিবারের এই প্রতিবেশিক বন্ধন বিগত এক দশক ধরে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত। আর এমনও শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে উপকূলীয় কৃষি পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন অনেক কৃষি পরিবার। উপকূলের সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামের শংকরী রানীর (৪৫) প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কৃষি বাড়ী তেমনই একটি কৃষি পরিবার।
স্বামী ও দুই সন্তান সহ চার সদস্যের ছোট্ট সংসার তার। স্বামী প্রশান্ত মন্ডল (৪৯) পেশায় ভ্যানচালক। বড় মেয়ে সুস্মিতা বালা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরির খোঁজে ব্যাস্ত এবং ছোট মেয়ে সংগীতা বালা জেলা শহরে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী দিনের অধিকাংশ সময়ে বাইরে ভ্যান চালানোর কাজ করেন। যদিও স্বামী ও সন্তানদের সহযোগিতায় কৃষি বাড়ির সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে হয় তার নিজ হাতেই। জানা যায়, শংকরীর দুই মেয়ে পরিবারের আর্থিক সহায়তার আশা কম থাকায় নিজেরা লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের স্বপ্ন নিজেদের কোন ভাই না থাকায় ভাইয়ের অভাব যেন পিতা মাতা বুঝতে না পারেন সে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশীপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় পরিবেশ পদক প্রাপ্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামে ধুন্দল সিএসও দলে যুক্ত হয়। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক আলোচনায় সভায় অংশগ্রহন করে আসছেন। কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসাবে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য একটি মটর, ১টি কদবেল ও পেয়ারার চারা, কিছু বীজ ও ১টি ছাগল ও দুটি মুরগী সহযোগিতা পান।
বারসিক এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতার এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের প্রচেষ্টা, শ্রম ও মনোবল দিয়ে পারিবারিক কৃষি পরিচর্যা চলমান রেখেছেন।
তিনি মাত্র ১৫ শতক বসতভিটায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ সহ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেন। ফলজ ও বনজ উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে আম জাম, কলা, নারকেল, পেয়ারা, সবেদা, লেবু, তাল, খেজুর, রেইনট্রি, খদি, নিম, কদবেল, পাতিলেবু, আঁশফল, কমলালেবু, ডালিম, কাঁঠাল, পেঁপে, ঔষধি উদ্ভিদবৈচিত্র্য হিসেবে বাগানে রয়েছে, কৃষ্ণ তুলসী, রাধা তুলসী, মাধবীলতা, রঙ্গন, নয়নতারা, পাথরকুচি, দূর্বাঘাস, মেহেদী, গাদাফুল স্থানীয় ফসল বৈচিত্র্য হিসেবে লালশাক, ডাটাশাক, পালংশাক, সীম, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঢেড়স, চালকুমড়া, উচ্ছে, করল্লা, বেগুন, টমেটো, ওল, কচুরমুখী, আদা, হলুদ, পুইশাক, সরিষা, মরিচ/ঝাল, আলু, ওলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মূলা, বড় আলু. মানকচু ইত্যাদি চাষাবাদ ও সংরক্ষণ ও প্রাণীসম্পদ হিসেবে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। এছাড়া নিজের মিষ্টি পানির পুকুরে সারা বছর স্থানীয় মৎস্যবৈচিত্র্য কৈ, শিং, মাগুর, মলা, শোল, ঢেলা, চ্যাং, ব্যাদলা, পুটি, মরুল্য, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, টেংরা, চিংড়ী ইত্যাদি চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করেছেন। সুব্যবস্থাপনার জন্য তার কৃষি খামারে সকল ফসলের নাম করণ দিয়ে ছোট সাইনবোর্ড দিয়ে সহায়তা করেছে বারসিক। শংকরী রানী এ বিষয়ে জানান “ তার বসতভিটায় নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন, ফলে বাজার থেকে খুব বেশী সবজী ক্রয় করা লাগে না।” পরিবারের চাহিদা পূরনের পাশাপাশি আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মাঝে মাঝে বিনামুল্যে বিনিময় ও বিক্রি করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। যা কিনা সঞ্চয় জমা, মেয়েদের পড়ালেখার খরচ সহ পারিবারিক কাজে ব্যয় করেন।
বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের ধুন্দল গ্রুপের সভানেত্রী হিসেবে শংকরী রানী স্থানীয় এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সরকারী বেসরকারী সেবা আদায়ের জন্য স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ সমন্বয় করেন। তিনি বারসিক থেকে একটি মটর সহযোগিতা পাওয়াতে তার কৃষি কাজকে আরো বেশী সহজ করেছেন। ফসল উৎপাদনে পানি সেচ ব্যবস্থাপণার জন্য মটরটি কাজে লাগিয়ে পূর্বের চেয়ে তুলনামূলক বেশী ফসল উৎপাদন করতে পারছেন। তিনি বলেন“ তার বাড়ীর নিকটবর্তী লবন পানির চিংড়ী ঘের রয়েছে। এলাকায় লবনাক্ততার প্রভাব সত্বেও বারসিক সহযোগিতা করায় লবনাক্ত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বা পরিবেশের সাথে টিকতে পারে এমন সব কৃষি ফসল উৎপাদন করেছেন। তিনি বলেন তার জলবায়ু সহনশীল জৈব প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ফসলের ক্ষেতে আকৃষ্ট হয়ে পাশর্^বর্তী বসবাসকারী পরিবার স্বরস্বতি, আঞ্জুয়ারা বেগম, শেফালী সহ অন্যান্যরা অনুরুপ কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন বা তোলার চেষ্টা করছেন। তিনি নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করে তার ক্ষেতের উৎপাদিত ফসলের লাউ বীজ, তরুল বীজ সহ অন্যান্য বীজ কয়েকটি গ্রামের নারীদের মধ্যে বীজ বিনিময় করেছেন।
শংকরী রানী নিজে একজন সফল কৃষানী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেনি এর পাশাপাশি তিনি বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন, স্থানীয় খালে সমবায় ভিত্তিক মৎস্য চাষে যুক্ত হয়ে পরিচিতি লাভ করেছেন। পাশাপাশি সরকারি বেসরকারী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এবং সে প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে লাগিয়ে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি খামার গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ শংকরী রানীর কৃষি পুষ্টি কানন উপকূলসহ বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষিঐতিহ্য, অস্থিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্থায়ীত্বশীল জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ন মডেল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় শংকরী রানী অবদান সকলের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
উন্নয়নশীল বিশে^র সবখানেই গ্রামীণ নারীরা কৃষি ও চাষাবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে কৃষিনির্ভর শ্রম শক্তিতে নারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশের চেয়েও বেশি। কৃষিক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর অংশ গ্রহণ বাড়ছে। গ্রামীণ নারীরা পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীরা বীজ সংরক্ষণ, বীজ বপন, রক্ষণাবেক্ষণ, সেচ ব্যবস্থাপনা, ফসলকাটা প্রায়ই করে থাকেন। কিন্ত এত কিছুর পরও মনে হয় নারীদের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি। এখনও নারীর শ্রম মূল্য, সম্পত্তিতে অধিকার পুরুষের সমানাধিকার পায়নি। তাই নারী কৃষকদের মতে যারা ফসল উৎপাদনবৃদ্ধিতে নিরালসভাবে কাজ করে যাচ্ছে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা প্রয়োজন।
ছবি- উপকূলের শ্যামনগরে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি খামার পরিচর্যায় সফল নারী শংকরী।
© Deshchitro 2024