◾ সাকিবুল হাছান: আত্মহত্যা মানে নিজেকে মেরে ফেলা। পৃথিবী থেকে নিষ্ঠুরভাবে বিদায় নেওয়া। কেউ নিজের মাথায় গুলি করে, কেউ বিষ খেয়ে, কেউ ফ্যানের সাথে ঝুলে, আবার কেউ উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কেন জীবিত মানুষ নিজের হাতে নিজেকে খুন করে! সব অবসাদ হতাশা পাওয়া না পাওয়ার হিসাব যেন এক নিমিষেই মিলে যায়। বর্তমান সময়ে আত্মহত্যা যেন পরিণত হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক মৃত্যুর মিছিলে। যার মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যার কারণ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা৷ জীবিকার তাগিদে বাস্তবতার নির্মম পরিহাসে যুবকের দীর্ঘশ্বাস মুক্তি খোঁজে আত্মহত্যায়।

 

 বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আত্মহত্যা করে ৮ লাখ মানুষ। দৈনিক এ হার ২ হাজার ১৯১ এবং প্রতি লাখে ১৬ জন। গত ৫০ বছরে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।  


গণমাধ্যম তথ্যানুসারে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ এবং বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ১০১টি ঘটনা ঘটে। 


সুস্থ মানুষের পক্ষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া সম্ভব নয়। আত্মহত্যার প্রবণতা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। আর মানসিক সমস্যা তৈরি হয় প্রচণ্ড ক্রোধ, আবেগ ও অপ্রাপ্তি থেকে। একজন মানুষ যখন মনে করে যে তিনি বেঁচে থাকার সমস্ত উপকরণ হারিয়ে ফেলেছেন এবং তার চলে যাওয়ায় পৃথিবীর কিছু যায় আসে না, তখনই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এটা তার অভিমান। আবার অনেকেই জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, পারিবারিক সহায়তার অভাবে, একাই নিজের জীবনের সমাপ্তি টানতে এই পথ বেছে নেন। কেউ কেউ তার ভুল কোনো পদক্ষেপের মাশুল হিসেবে আত্মহত্যা করেন।


       বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিত ফল, প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।



        কিন্তু আত্মহত্যা কি সমস্যার সমাধান হতে পারে? পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাবিধ সমস্যা থাকবেই। পরিবার ভেঙে যেতে পারে, সমাজ ও রাষ্ট্র সবার সমস্যার সমাধান নাও দিতে পারে। তাই বলে আত্মহত্যা সমস্যা থেকে মুক্তির পথ হতে পারে না। 

         কবিগুরু বলেছেন, “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” কিন্তু সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় ওপারে চলে যেতে যান। যাকে আমরা আত্মহত্যা বলি। স্বভাবতই মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রবণতা বেশি৷ আত্মহত্যা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য আমাদের সমাজে কখনই কাম্য নয়। কারণ আত্মহত্যা কখনই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসে যে সফল হওয়া যায় তা উপলব্ধি করতে হবে। নতুন করে শুরু করতে হবে। 

      পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই আত্মহত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, আত্মহত্যা মহাপাপ! এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে ওটা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করব, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।” (সুরা নিসা ২৯-৩০)।


           আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, একটি পরিবার ও আত্মহত্যাকারীর আপনজন বন্ধু-বান্ধবদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রতিটি মানুষের জীবনে সমস্যা দেখা দিতেই পারে। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই জীবন। আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে সেটাকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।


    মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্ররোচনা বন্ধ করতে হবে। মানুষ যখন একেবারে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে তখনই মনে করে তার জীবন শেষ। তবে এখানেই হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। নতুন করে জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আত্মহত্যার দাঁড়প্রান্ত থেকে ফিরে এসে জীবনে সফলতায় পৌঁছেছেন এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাই মনে রাখতে হবে কোনো কিছুতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

         মানবিকতার বিকাশ ছাড়া আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়। আত্মহত্যাকে ‘না’ বলতে হবে। জীবনকে ভালোবাসতে হবে। পৃথিবীর বুকে আমাদের আগমন কেবল একবার। সেই এক জনমকে ব্যর্থতা দিয়ে নয়, সফলতা দিয়ে পূর্ণ করে তুলতে হবে। জীবনটাই একটা যুদ্ধক্ষেত্র। হারলেন কি জিতলেন, তা মুখ্য নয়। যোদ্ধা হয়ে বেঁচে থাকাটাই সাফল্য।


         আত্মহত্যা প্রতিরোধে ডব্লিউএইচওর লাইফ পদ্ধতির চারটি প্রধান হস্তক্ষেপের সুপারিশ করেছে, ১) আত্মহত্যার উপায়গুলো অনলাইনে অ্যাক্সেস সীমিত রাখা। ২) আত্মহত্যার দায়িত্বশীল প্রতিবেদনের জন্য মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করা। ৩) কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক-মানসিক জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি। ৩) আত্মঘাতী আচরণ দ্বারা প্রভাবিতদের তাড়াতাড়ি সনাক্ত, মূল্যায়ন, পরিচালনা ও অনুসরণ করা।

            আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, তবে যদি একটি গবেষণানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়, তরুণদের মাঝে যদি ভালো প্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়ার পরিবর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ তৈরি করতে পারে তবে কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের হতাশা দূর করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মানোন্নয়ন করতে হবে, এতে কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষকরা সহজেই বুঝতে পারবেন এবং হতাশা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। সর্বোপরি আমাদের একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে জীবনের জন্য স্বপ্ন, স্বপ্নের জন্য জীবন নয়।


সাকিবুল হাছান

তরুণ লেখক ও শিক্ষার্থী

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024