ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও  ডিসির জিআর চাল বরাদ্দ 


মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সরকারি বরাদ্দ জিআর (ত্রাণ কার্য উপ-বরাদ্দ) চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগের তীর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা, স্থানীয় চালের ডিলার ও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দিকে।

জেলা ত্রাণ ও পুণর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের অনূকুলে বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি/বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চলতি বছরের জুন মাসে  ৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। 

বরাদ্দের কাগজ হাতে পাওয়ার পর শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ণ কার্যালয় থেকে বরাদ্দকৃত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চালের পরিবর্তে নাম মাত্র নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। এতে চাল বিতরণে সাগর চুরি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ২ হাজার কেজি চালের বিপরীতে শ্রীমঙ্গল শহর-শহরতলী এবং উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা, কাউকে ২০ হাজার আবার কাউকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। অথচ ২ টন বা দুই হাজার কেজি চালের বাজার মূল্য ১ লক্ষ ২ হাজার টাকা বলে প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় শ্রীমঙ্গল শহরের সিন্দুরখান রোডের পশ্চিমভাগ বায়তুন নূর জামে মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার মির্জা শামিম এর সাথে। বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জুন মাসে আমাদের মসজিদে উপজেলা থেকে  ১০ হাজার টাকা অনুদান পাই। ২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ ছিল এটা জানতামনা। 

বনবাড়ী নূরে মদীনা জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, আমাদের মসজিদে শহরের এক ব্যবসারি মাধ্যমে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। ২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ ছিল এটা জানা ছিল না।

রামনগর কাকিয়ারপুল এলাকার ছওতুল হেরা নুরানী মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার এক বন্ধুর বাবার মাধ্যমে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছি। কত চাল বরাদ্দ ছিল তা জানি না।

শ্রীমঙ্গল শহরের সাগরদিঘী রোডের মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম  হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা আবুল কালাম ইউসুফী বলেন, গত জুন মাসে মৌলভীবাজার থেকে আমার এক উস্তাদ ফোন দিয়ে বলেন তোমার মাদ্রাসার নামে উপজেলা থেকে ২ টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। এটা পেয়েছ কি-না? তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না আমার মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ হয়েছে। পরবর্তীতে উপজেলা মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ফেরদাউস আহমদ সাহেব জানালেন উপজেলা থেকে টাকা নেয়ার জন্য। টাকা আনতে উপজেলায় গেলে নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এসময় আমি প্রশ্ন করলাম আমার মাদ্রাসার নামে তো ২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ তাহলে ২০ হাজার টাকা কেন? উপজেলা মসজিদের ইমাম বলেন, উপর থেকে কমে আসতে আসতে এটা রয়েছে। টাকা আনার পর আমি ২০ হাজার টাকার রিসিটও ইমাম সাহেবকে পৌছাই। তখন তিনি সংবাদকর্মীকে রিসিট বের করে দেখান।

আল আমিন মাদ্রাসা ও এতিমখানার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কাশেম বলেন, আমার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুশ শাকুর সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে বলেন জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে উপজেলায় যাওয়ার জন্য। কাগজপত্র নিয়ে উপজেলায় গেলে মাদ্রাসার নামে নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে যে দুই টন চাল বরাদ্দ আমি জানি না।

টিকরিয়া বি-চক সুন্নিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল আহাদ বলেন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বদরুল হক এর মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছি। কত টন চাল বরাদ্দ ছিল আমার জানা ছিল না।

পূর্ব সিরাজনগর হাফিজিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা নুর উদ্দিন বলেন, গত জুন মাসে উপজেলা থেকে ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। মাদরাসার নামে ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল আমি আগে জানতাম না।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের শংকরসেনা জামেয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া কাওমিয়া মাদ্রাসার আমেলা কমিটির সদস্য কামাল মিয়া বলেন, শ্রীমঙ্গল শহরের চাল ব্যবসায়ী মোবারক মিয়ার কাছে ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড দিলে তিনি ২০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন উপজেলা থেকে আপনার মাদ্রাসার নামে এই টাকা বরাদ্দ হয়েছে। দুই টন চাল যে বরাদ্দ ছিল তা আমরা জানতাম না। তবে টাকা পাওয়ার আমি ২০ হাজার টাকার রিসিটও তাকে দেই। এসময় তিনি এ প্রতিবেদককে রিসিটও দেখান।

আশিদ্রোণ জামিউল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক  মাওলানা আব্দুল মালেক বাহুবলী বলেন, চাল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন ফোন দিয়ে বলেন, সরকারিভাবে আপনার মাদ্রাসায় কিছু অনুদান এসেছে, ছবি ও এনআইডি কার্ড জমা দিয়ে টাকা নিয়েন। পরবর্তীতে কাগজপত্র জমা দিয়ে উনার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা পাই। টাকা পাওয়ার ২০ হাজার টাকার রিসিটও তাকে দেই। এসময় তিনি পত্রিকার প্রতিনিধিকে রিসিটও বের করে দেখান।

শহরের মৌলভীবাজার রোডের মারকাযুল কুরআন মডেল মাদরাসার পরিচালক হাফেজ মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, আমি উপজেলা থেকে সরকারি বরাদ্দের ৩০ হাজার টাকা পেয়েছি। কত টন চাল বা কত টাকা বরাদ্দ ছিল তা জানা ছিল না।

বিরাহিমপুর নূরে মদীনা জামে মসজিদ ও হাফেজিয়া মাদরাসার মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ কামাল হোসেন বলেন, বরাদ্দে আমার মাদরাসার নাম থাকলেও আমরা কোনো অনুদান পাইনি।

দক্ষিণ মুসলিমবাগ আল মদীনা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের মসজিদের নামে যে ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল জানতাম না। গত জুন মাসে উপজেলা থেকে আমরা কোনো অনুদান পাইনি। 

জালালিয়া রোড হাফিজিয়া মাদ্রাসার কমিটির সেক্রেটারি শাহেদ আহমদ প্রথমে অনুদান পাননি বললেও, কিছু সময় পর মুঠোফোনে বলেন, এখন খোঁজ নিয়ে জেনেছি আমাদের নামে বরাদ্দ আছে, কিন্তু কত টাকা তা উপজেলায় না গিয়ে বলতে পারবো না। 

রামনগর আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠতা আবুল কালাম বলেন, আমাদের মাদরাসার নামে যে ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল জানতাম না। আমরা কোনো টাকা পাইনি।

আশিদ্রোন লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মনির উদ্দিন বলেন, আমাদের মসজিদের নামে যে ২ টন চাল বরাদ্দ ছিল জানিই না। গত জুন মাসে উপজেলা থেকে আমরা কোনো টাকা পাইনি। 

এছাড়া বরাদ্দের তালিকায় নাম আছে কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি দক্ষিণ শাহীবাগ আল আকসা জামে মসজিদ ও হেফজখানা, দক্ষিণ মুসলিমবাগ নূরে মদীনা জামে মসজিদ ও হেফজখানা, বিরাইমপুর নূরানী মাদ্রাসা ও এতিমখানা, দক্ষিণ মুসলিমবাগ হেফজখানা, মারকাজুল উলুম হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা, নূরে মদীনা হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা, জামেয়াতুন সুন্নাহ ইসলামিয়া মাদরাসা ও হেফখানা, নুরুল কুরআন হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা।

বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান বলেন, যখন বরাদ্দ আসে তখন আমি দেশের বাইরে (হজে) ছিলাম। আর আমি গত ১ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে জয়েন করি। তবে আমি যোগদানের পর কিছু প্রতিষ্ঠানে নিজে দিয়েছি। উপজেলা মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ফেরদাউস আহমদ ২৯টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছিলেন, তার মাধ্যমেও কিছু প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দের অর্থ দেয়া হয়েছে। 

বরাদ্দে আত্মসাৎ এবং অনিয়মের ব্যাপারে তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই যদি এসব প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ যদি কেউ নিয়ে থাকে তাহলে তাদের কাছ থেকে বরাদ্দ ফেরত আনা হবে, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

দুই টন বরাদ্দকৃত চালের বর্তমান বাজার মুল্য কত জানতে চাইলে  প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন ১ লক্ষ দুই হাজার টাকা। তাহলে বরাদ্দের তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেনো কম দেয়া হলো এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, বরাদ্দের তালিকায় থাকা যেসব প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পায়নি তাদের বরাদ্দ দেয়া হবে এবং অবশিষ্ট বরাদ্দও দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিতরণ করা হবে।


সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ এবং অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠু বলেন, এরকম অনিয়মের বিষয়ে আমি গতকাল অবগত হয়েছ এবং এমপি স্যারকে অবগত করেছি। এ বিষয়ে আরও তদন্ত ও খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা হজে থাকায় বরাদ্দগুলো সঠিক সময়ে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্তে অনিয়ম এবং আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে দায়িদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এতিমখানা, মাদরাসা মসজিদের নামে সরকারি বরাদ্দের ১ টাকাও যদি কেউ আত্মসাৎ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যে বা যারা অনিয়মের সাথে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে কম দেয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউএনও বলেন, টাকা মেরে খাওয়ার সুযোগ নেই, দুই টন বরাদ্দ হলে ২ টন বা এর সমপরিমাণ টাকা দেয়া হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। বরাদ্দের চেয়ে কম দিয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখে নির্ধারিত বরাদ্দই দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। ইউএন আরও বলেন আমি শ্রীমঙ্গলে যোগদানের পর থেকে গরিম অসহায়দের সার্বিক কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। রমজানে পথচারি, গরিব অসহায় আলেম মাদরাসা মসজিদে ইফতার খাদ্য সামগ্রি দিয়েও সহযোগিতা করেছি। আর আলেম, এতিম, মাদরাসা মসজিদের টাকা কেউ মেরে খাবে তা হতে পারে না। আমি এ বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নেবো।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024