◾মুফতি উবাইদুল্লাহ তারানগরী : ঈমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। প্রকৃত ঈমানদারের দ্বারা কখনো পৃথিবীর কেউ কষ্ট পায় না। বরং বিশ্ব আলোকিত হয়। শান্তিতে ভরে যায়। তাই আমাদের প্রকৃত মোমিন হতে হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন; প্রকৃত মোমিন সেই যার জবান ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। সব মুসলমান ভাই ভাই। মুসলিমরা সবাই একই দেহের মত। দেহের কোন অঙ্গে চোট বা ব্যথা লাগলে যেমন সারা শরীর ব্যথিত হয়ে যায় তেমনি পৃথিবীর কোথাও মুসলমান আক্রান্ত হলে সবারই তাদের ব্যথায় ব্যথিত ও শোকে শোকাহত হওয়া উচিত। বিপদে-আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। সামর্থ্যের সবটুকু করা উচিত। দোয়া ও প্রয়োজনে কুনুতে নাজেলাও পড়া যেতে পারে। কুনুতে নাজেলা মোমিনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। নবীজির প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ। চল


• কুনুতের অর্থ: 


কুনুত অর্থ অনুসরণ করা, ইবাদত করা, দোয়া করা, নামাজে দীর্ঘক্ষণ কিয়াম করা। পরিভাষায় সঙ্কটকালে কারো জন্য দোয়া বা বদদোয়ার উদ্দেশে পাঠের নির্দিষ্ট দোয়া। যাকে কুনুতে নাজেলা বলা হয়। (মাজাহেরে হক ২/ ২০১পৃ.)


• কুনুত দুই প্রকার: 

১.কুনুতে রাতেবা ২.কুনুতে নাজেলা


রাতেবা যা প্রতিদিন পড়া হয়। শুধু বিতির নামাযে। তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে। শুধু রমজানে বিতিরের নামাজ জামায়াতের সঙ্গে পড়ার নিয়ম রয়েছে। এগারো মাস দোয়ায়ে কুনুত একা পড়াই বিধান। (মালাবুদ্ধা মিনহু) 


• কুনুতে নাজেলা পাঠের সময়:


ইসলাম ও মুসলমান বিশেষ কোনো বিপদ বা দুর্যোগে পড়লে বিপদ থেকে মুক্তির জন্য কুনুতে নাজেলা পড়ার নিয়ম রয়েছে। শত্রুর নির্মম আগ্রাসন থেকে রক্ষা, শত্রুর হেদায়েত কিংবা ধ্বংস কামনার জন্য কুনুতে নাজেলা পড়া মুস্তাহাব। বিশেষ মুহূর্ত অর্থাৎ কঠিন বিপদ, যুদ্ধকালীন সময় বা এমন বিপদ সংকুল পরিস্থিতিতেই শুধু কুনুতে নাজেলা পড়ার নিয়ম। 


• নবীজির কুনুতে নাজেলা পাঠ:


৪র্থ হিজরির সফর মাসে বীরে মাঊনার ঘটনায় ৭০ জন প্রখ্যাত সাহাবি যারা ছিলেন আসহাবে সুফ্ফার নিবেদিত প্রাণ সদস্য। কুরআনের হাফেজ আলেম। দিনে কাঠ বিক্রি করে খাবার জোগাড় করতেন। রাতে কুরআন গবেষণা করতেন। রা'ল, যাকওয়ান, উসাইয়া গোত্রসমূহের বিশ্বাসঘাতকতায় শাহাদাত বরণ করলে নবীজি অনেক কষ্ট পান। এবং তাদের বদদোয়ার জন্য কুনুতে নাজেলা পড়েন। 


তাবেয়ি আসেম আহ্ওয়াল (রহ.) বলেন, একদা আমি হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) কে নামাজের দোয়ায়ে কুনুত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, এটি রুকুর আগে না পরে? তিনি বলেন রুকুর পূর্বে। রাসূল (সা.) কেবল এক মাসই রুকুর পরে কুনুত পড়ে ছিলেন। ব্যাপার এই ছিল যে, একবার তিনি (বীরে মাঊনার দিকে) ৭০ জন সাহাবিকে প্রেরণ করে ছিলেন, যাদেরকে কারি সাহেবান (কুরআনের আলেম) বলা হত। তাঁরা সেখানে নিহত হন। অতপর রাসূল সা. এক মাস যাবৎ রুকুর পরে কুনুত পড়েছেন এবং তাদের জন্য বদদোয়া করেছেন।(বোখারি, মুসলিম, মোয়াত্তা, মেশকাত ২/ ১১৪) 


• নাজেলার বিধান রহিত হয়নি:

কুনুতে নাজেলা পড়ার বিধান রহিত বা বাতিল হয়নি এখনো মুসলমানদের বিপদ বা দুর্যোগকালে ফজরের নামাজে কুনুতে নাজেলা পড়ার নিয়ম রয়েছে। কেয়ামত পর্যন্তই এই বিধান থাকবে (এলাউস সুনান – ৬/৮১)


• দুর্যোগকালেই"কুনুতে নাজেলা" পড়তে হয়:


কুনুতে নাজেলা সবসময় পড়ার বিধান নেই। বিপদ মুসিবত ও সঙ্কটকালেই নাজেলা পাঠের নিয়ম। হজরত আবু হুরায়রা( রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাজের সময় সবসময় কুনুত (নাজেলা) পড়তেন না। কোন জাতির জন্য দোয়া বা বদদোয়ার প্রয়োজন হলে ফজরের নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে রুকু থেকে মাথা উঠানোর সময় তিনি কুনুতে নাজেলা পড়তেন। (সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস, ১০৯৭, নসবুর রায়াহ, আল মুসনাদুল জামে, আসারুস সুনান, ২/২০)


অন্য হাদিসে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় রাসূল ( সা.) ফজরের নামাজের সময় কুনুত পড়তেন না, শুধুই একমাস পড়েছিলেন। এর আগে বা পরে আর এমনটি করতে দেখা যায়নি। সে সময় তিনি কিছু মুশরিকদের বদদোয়া করার জন্য তা পড়েছিলেন। (মুসনাদে আবী হানীফা বিরিওয়াতে হিসকাফী, হাদীস, ৩৪)

হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, নিশ্চয়ই নবী করীম সা. মাত্র এক মাস কাল কুনুত পড়ে ছিলেন। অতপর তা ত্যাগ করেন।( আবু দাউদ ও নাসায়ি)


• কুনুতে নাজেলা পড়ার নিয়ম: 

ফজরের নামাজের ২য় রাকাতের রুকুর পর দাঁড়িয়ে নিম্নোক্ত দোয়াটি পরে নামাজ শেষ করবে। অতপর দোয়া করবে। (এলাউস সুনান – ৬/৮১)


• কুনুতে নাজেলা:


বাংলা উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাহদিনা ফীমান হাদায়্ত। ওয়া আফিনা ফীমান আফায়ত্। ওয়া তাওয়াল্লানা ফী মান তাওল্লায়ত্। ওয়া বারিক লানা ফী মান আ'তায়ত। ওয়াকিনা শার্রা মাকাজায়ত। ফাইন্নাকা তাকজি ওয়ালা য়ুকজা আলাইক্। ওয়াইন্নাহু লা য়াজিল্লু আলা মান ওয়া লাইয়ত্। ওয়ালা য়াইজ্জু আলা মান আদাইয়ত। তাবারাকতা রাব্বানা ওয়া তায়ালায়ত। নাসতাগফিরুকা ও নাতুবূ ইলাইক্। ওয়া সাল্লাল্লাহু আলান্নাবিয়্যিল কারীম। আল্লাহুম্মাগফিরলানা ওয়ালিল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত। ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত। ওয়া আল্লিফ বাইনা কুলুবিহিম। ওয়া আসলিহ জাতা বাইনিহিম। ওয়াংসুরহুম আলা আদুয়্যিকা ওয়া আদুয়্যিহিম। আল্লাহুম্মালআন কাফারাতা আহলিল কিতাবিল্লাাজিনা ইয়াসুদ্দুনা আন সাবিলিকা। ওয়া ইউকাজজিবুনা রুসুলাকা। ওয়া ইউকাতিলুনা আওলিয়াআকা। আল্লাহুম্মা খালিফ বাইনা কালিমাতিহিম। ওয়া যালযিল আকদামাহুম। ওয়া আনযিল বিহিম বাসাকাল্লাজি লা তারুদ্দুহু আনিল কাওমিল মুঝরিমিন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা ওয়া নুছনি আলাইকা ওয়ালা নাকফুরুক ওয়া নাখলাউ ওয়া নাতরুকু মাইঁ-ইয়াফজুরুকা। আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া লাকা নুসাল্লি, ওয়া নাসজুদু, ওয়া লাকা নাসআ, ওয়া নাহফিদু, নাখশা আজাবাকালঝাদ্দা, ওয়া নারজু রাহমাতাক। ইন্না আযাবাকা বিল কাফিরিনা মুলহিক।’ (বাইহাকি)



লেখক: মুফতি উবাইদুল্লাহ তারানগরী

শিক্ষক: জামিয়া ইবনে আব্বাস রা সামান্তপুর জয়দেবপুর , গাজীপুর সিটি। 


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2023