|
Date: 2023-10-22 09:37:16 |
◾মো: নেছার উদ্দিন চৌধুরী: আত্মহত্যা মূলত আত্মপ্রবঞ্ছনারই নামান্ত। কারণ জীবন বিসর্জন দেয়া কি কোন সমাধান? কোন সফলতা? কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম? যদি তা না হয়, তাহলে কেন এত আত্মহত্যা? আর, কেন এত অকাল মৃত্যু? কেন এই সুন্দর,প্রতিমাময় জীবন নষ্ট? এতগুলো কেনোর কোন সঠিক উত্তর বা স্থায়ী সমাধান আছে কি? ডব্লিউ এইচ ও এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। এর অর্থ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে। সারা বিশ্বে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে তার ৭৫% হয়ে থাকে নিম্ন বা মধ্যবর্তী দেশগুলোতে। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার কারণে যে সকল লোকদের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে ০.০৬% বাংলাদেশী। তাদের মধ্যে ২০১২ সালে পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যেই আত্মহত্যাই মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ।এছাড়া, WHO প্রিভেন্টিং সোসাইড: এ গ্লোবাল ইমপারেটিভ শিরোনামে ১৭০ টি সদস্য রাষ্ট্রের উপর গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যায় বিশ্বে দেশগুলোর অবস্থান জানা যায়, যেখানে এগিয়েছিল ভারত।এই তালিকাতেই বাংলাদেশের স্থান ১০ নাম্বারে। দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মহত্যার হার বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের তুলনায় বেশি। ভারতে প্রতি দুই মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে।
২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ আর বাংলাদেশে তা ১০ হাজার ১৬৭ জন ছিল তার মধ্যে ৫৭৭৩ জন নারী ও ৪ হাজার ৩৯৪ জন পুরুষ।তরুণ সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন এর এক প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪. ৩৬ শতাংশ বেড়েছে এবং করোনাকালীন এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ।
বাংলাদেশের প্রতিবছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭.৮ থেকে ৩৯.৩ জন। ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। এ সংখ্যা ২০২২ এ ছিল ৮৬ জন। এছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (স্কুল ও কলেজ) ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। ওই ৮ মাসে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪% স্কুল গামী শিক্ষার্থী। এছাড়াও প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে (সমমানের মাদ্রাসা) শিক্ষার্থীর সহ ৪৪৬ জন আত্মহত্যা করেছে।
নারীদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা অনেকাংশই বেশি। ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৪০ জন নারী লাঞ্ছনা শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। ২০০১ থেকে ২০১০ শারীরিক ও ঘরোয়া সহিংসতার কারণে ৪.৭৪৭ একজন মহিলা ও মেয়ে আত্মহত্যা করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০১০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক লক্ষ জন মানুষের মধ্যে ৮৯% মহিলা এবং বেশিরভাগই অবিবাহিত। তাদের মধ্যে ১২৮.০৮ শতাংশই আত্মহত্যা করে।
এত সব প্রাণগুলো যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটার জন্য কি তাদের পরিবারগুলো, তাদের সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক ভঙ্গুরতা, তাদের রাষ্ট্র কি কোন অংশে দায়ী কিনা? আত্মহত্যার কারণগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের সাথে মান-অভিমান করে প্রায় ২৭.৩৬% স্কুল কলেজে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে গত বছর। প্রেম গঠিত কারনে ২৩.৩২% আত্মহত্যা করে।আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়ানোর জন্য ছয় জন। শিক্ষকের মাধ্যমে অপমানিত হয় ৬ জন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন। এমনকি আত্মহত্যা এতই সহজ হয়ে গেল যে মুঠোফোন কিনে না দেয়ায় ১০ জন।মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় ৬ জন এবং গেম খেলতে বাধা দেয়ায় ৭ জনের আত্মহত্যা করার খবর পাওয়া যায়। এই প্রত্যেকটা কারণের মূলে রয়েছে ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থা। পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বহীনতা এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলা।
ডব্লিউ এইচ ও প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে ১৭০ টি সদস্য দেশ নিয়ে।প্রতিটি দেশে একটি করে কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আত্মহত্যা কমানোর জন্য। কিন্তু মাত্র ২৮ টি দেশের সরকার এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এখন পর্যন্ত। এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, ইউএসএ, ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশ আত্মহত্যার উপকরণগুলো সহজলভ্যতা কমিয়ে এনে তারা সুফল পেয়েছ। যা একটি কর্ম পরিকল্পনার অংশ ছিল। এছাড়া নেপালে আত্মহত্যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ তাই সেখানে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে কারা ভোগ বা অর্থদণ্ড দিতে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হয়। তাই, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে এ ঘটনা কম ঘটে। এভাবে করে রাষ্ট্র আত্মহত্যা প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারে।
এছাড়া, পরিবার, সমাজ থেকে প্রত্যেক মানুষের যে আশা থাকে তা বিনষ্ট হলেই কোন মানুষ মূলত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। তাই, পরিবারের কোন সদস্য বা সমাজের প্রত্যেক মানুষের উচিত একে অপরকে সাহায্য করা, অবহেলা করা নয়। পিতা মাতার কখনোই উচিত নয় যে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে, চাকরি না পাওয়া নিয়ে, ভর্তি পরীক্ষার অকৃতকার্য হওয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করা। ঠিক একইভাবে, সমাজের প্রত্যেকের উচিত কোন দুঃসংবাদ পেলে ব্যক্তিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করা। তাকে হেনস্থা না করে। সাহস যোগানো। কোন নারী সাইবার বোলিং এর শিকার হলে তাকে নিয়ে জনে জনে কথা না বলে ওই নারীর মনকে সান্ত্বনা দিয়ে চেষ্টা করা। যখনই আমরা নিজের জন্য যেটা ভালো মনে করি অপারের জন্যও সেটা ভালো মনে করতে সক্ষম হব তখনই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব। সমাজকে, রাষ্ট্রকে এবং এই বিশ্বকে পরিবর্তন করতে হলে প্রত্যেক সদস্যকে এক একজন কিংবদন্তি হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একজন পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে আলো ছড়াতে হবে। সর্বোপরি, এক একজন অগ্রগামী নেতা হয়ে এই জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বের মানুষদের আত্মহত্যা প্রবণতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। তবেই, আমরা পারবো কবি আহসান হাবিবের সেই অস্ত্র উত্তোলন করতে।
লেখক: মোঃ নেছার উদ্দিন চৌধুরী।
শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
© Deshchitro 2024