|
Date: 2023-10-26 02:03:31 |
◾বসুদেব রায় : সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা,অপরুপ সৌন্দর্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ।যতটা আশ্চর্যের বিষয় এদেশের প্রকৃতি, তার চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক এদেশের জনজীবন।আর সেই জনজীবন যদি হয় পল্লী জনজীবন তা হলে তো কোনো সন্দেহ নেই।প্রয়োজনে তারাই নগরায়ন তৈরি করেছে নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করার জন্য, তবু এদেশে গ্রাম্য-পল্লি এখনও রয়ে গেছে। না থাকবেই বা কেন,এদেশের ভিত্তি তো পলি মাটির সৌরভ দিয়ে গড়া।তবে আজ পল্লি রুপকথার ন্যায় পদ্যে-গদ্যে বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে। গোলা ভরা,গোয়াল ভরা,উঠান ভরা এসব প্রাচুর্য সবোই সত্য কথা, তবে সবার ছিল না।সময়ের স্রোতে সবকিছুরেই পরিবর্তন হয়েছে।পল্লীতেও পরিবর্তন ঘটেছে তবে যতটা সংযোজন হয়েছে তার চেয়েও বেশি হয়েছে বিয়োজন। পল্লি মানেই যেন কলকাকলির মুখরিত ধ্বনি,সবুজ সোনালীর ফসলের মেলা, আরামপ্রিয়তা,সহজ-সরল
জীবনচারণ,মূল্যবোধের শিক্ষা, অতিথিপরায়ণের স্তম্ভ, অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতিত্বোধের জন্ম, স্নেহময়ী নারীর আত্মত্যাগের কাহিনী।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে,রাত্রি আসে দিবসের প্রথম প্রহরে। ঘুম ভাঙ্গে মানুষের কোলাহলে,পারি না আর শুনতে ভোরের পাখির মুখরিত ধ্বনি। বসন্তের কোকিলের কুহু কুহু তো দুরের কথা কাকের কা কা ধ্বনিও আর ভাসে না গ্রাম বাংলার বাতাসে। এক সময়ে পল্লির সেই ঐক্য সুরে মুগ্ধ হয়ে অনেকে সাহিত্যেকর্ম রচনা করেছেন । এই তো বিংশ শতকে সুকুমার বড়ুয়ার চোখে দৃশ্যায়ন হয়েছিল তাই তিনি লিখেছেন "পল্লীর সেই সুর ভরে যায় মন"।কিন্তু এখন সেই সুর আর সুরের জায়গায় নেই, সৃষ্টি হয়েছে তীক্ষ্ণ স্বরের শাণিত আওয়াজ। আর জমে না পালার আসর, সন্ধি করে না জন সমারোহ। তার পরেও যখন ঘরে-দোকানে দূরদর্শনের পর্দার গুটি কয়েক চোখ ঝুলতো,তখনো বেশ বিজ্ঞপ্তিযুক্ত নাটকের পর্বেও রেশ থাকতো। এখন তো একাকিত্বের জয়জয়কার চতুষ্কোনে। এতেই আবদ্ধ হয়ে মানুষ হয়েছে একরোখা, নিষ্ঠুর,শ্বাপদসংকুল।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় সৃষ্টিধারায় আমরা প্রান্তিকেরা অত্যন্ত অবুঝ বালকের ন্যায় হেয়ালিপনায় দিনাপাত করতেছি।আমরা আরামপ্রিয় ছিলাম অনেক আগ থেকেই, তদাপিও কাজে-কর্মে ছিল রংবেরঙের বৈচিত্র্য। তাই তো সৃষ্টি হয়েছিল নদীকেন্দ্রিক জেলে,মাটিকেন্দ্রিক কুমার,লোহাকেন্দ্রিক কামার,আরও অনেক পেশা হকার,ফেরিওয়ালা, মুচি, মৌয়াল আরও কত কি।সময়ের সাথে এসব পেশার লীন ঘটেছে,মানুষ পেয়েছে কর্মহীন জীবন। যা নতুন পেশা সৃষ্টি হয়েছে তাতেই ভীড় জমিয়েছে হাজারো মানুষ। এতে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, তবে এরুপ নব্য কাজে কর্মদক্ষতাহীন মানুষ তাদের মননশীলতাকে হারাচ্ছে।সৃষ্টি হচ্ছে মানুষের মাঝে তীব্র হেঁয়ালিপনা।হেঁয়ালিপনা যেখানে মানুষের নিত্যদিনকার সঙ্গী সেখানে অস্তি ও স্নায়ুর কিনায় কিনারায় বালাইয়ের উদ্দীপনা। কর্মহীন মানুষ আজ বুকের মাঝে লুকায়িত কষ্ট, হার্ট এট্যাকের জন্ম দিয়েছে; মস্তিষ্কের ঘর্সিত জীবন চালনার হাজারো যুক্তি, মিলাতে না পেয়ে দিয়েছে ব্রেইন স্ট্রোকে মুক্তি;শরীরের কঠিন অঙ্গগুলোর চির ধরার সাথে সাথে তরল রক্তে ক্যান্সারের সৃষ্টি, বায়ুতেও সৃষ্ট গ্যাস পেইন মাত্রা বেড়েই চলেছে।
আমাদের গায়ের রং,গঠন কাঠামো, পোশাক-পরিচ্ছেদ ধর্মীয় রীতিনীতি আলাদা তাই আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ।আমাদের জীবনপ্রণালি আমাদের মতো,হ্যাঁ এখন বিশ্ববাণিজ্য সময়ের দাবি তাই বলে কী নিজেকে ভুলে যাবো। অমুক কোনো দিনেও তমুক হতে পারে না, এজন্যই সে অমুক। তদরুপ আমরাও কভু পশ্চিমা ও পাশ্চাত্য হতে পারবো না। অযাচিত-অহেতুক বিবরণে ক্যানোই বা আমরা আজ তাদের সামিল হচ্ছি।প্রয়োজনেই মনে হয় না, নিজের টাকায় নিজের চর্ম ঘসে অন্যের উপযোগী করার।এতে অর্থদন্ড, চর্মদন্ড ও পরিহাসদন্ডের পাত্র হয় মাত্র।এ কথা ভুলে গেলে চলবে না,প্রাচীন কাল থেকে এদেশ আকৃষ্ট করার মতো দেশ তাই সময়ের সমাবর্তনে এদেশের হয়েছে বিবর্তন। এতেই আমাদের কৃষ্টির বিমাতৃসুলভ ঢেউয়ে কিনারা ভেঙ্গে পরছে তাতে একনিষ্ঠভাবে সামিল হচ্ছে পল্লী সমাজ।
শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। আর শিক্ষা জীবনকে পরিচালনার, সমাধানের একগুচ্ছ নোট। সে হিসাবে,সমস্যার তারতম্যের ফলে সমাধানেরও তারতম্য আনা উচিত। যেহেতু অবস্থাগত কারণে সমস্যার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।আজ প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষা বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছে, কেননা তা শুধু বই-পুস্তকের গন্ডিতে মোড়ানো হয়েছে। তাই প্রাত্যহিক মিলছে মানহীনতা,নিপীড়ন, খিস্তির আড্ডা বাজি,আরও অনেক আঁধারিও কর্মকান্ড।সৃষ্টি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাড়ছে সামাজিক নৈরাজ্য যা শিক্ষার মানদণ্ডে কোনোভাবে কাম্য নয়।
আজও হুমায়ুন আজাদ স্যারের, তিক্ত অমরতার বাণী, "বাঙলায় নারীদের পেশা বিবাহ" প্রান্তিক সমাচারে শিরোনাম হিসেবে রয়ে গেছে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে নারী জাগরণ প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পেলেও লোকান্তরে ও ভাবান্তরে নারীদের বিবাহকেই পেশা হিসেবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। তাই এখনও সমাজে নারী বিবাহের মাধ্যমে নারীর সৃজনশীলতার সমাপ্তি ঘোষণা করতেছে। আধুনিকতার যুগে এসে কেনোই বা এই বদ্ধ ধারণাকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। কেনোই বা পল্লী নারীদের মননশক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না।আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নারী কর্তৃত্বহীন সমাজ, যা একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক অগ্রসরতার প্রধান প্রতিবন্ধক।তাই অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা মোকাবিলায় পল্লী নারীর আত্মত্যাগ নয়, চাই তাদের উদ্যমশক্তির স্বচ্ছ ব্যবহার।
অবহেলিত প্রান্তিকদের আধুনিকতা শেখানো হচ্ছে, অথচ কোনোরুপ আধুনিকতার ব্যবস্থা ছাড়াই। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রান্তিক জনমানুষের কোনো জুরি নেই। তাই সমাজের এরুপ প্রান্তিক অবস্থা বিবর্তনে ন্যায্য মানসিকতা উত্তরণ আজ সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে।
লেখক : বসুদেব রায়
শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম,রাবি শাখা।
© Deshchitro 2024