টানা ১ বছর দুইমাস পর শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের দি বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারি ক্লাসের শিক্ষার্থী নাঈম উর রহমান।

মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) সকাল ১০টায় শিশু নাঈম উর রহমান-কে নিয়ে স্কুলে আসেন তার পিতা আব্দুর রহমান। 

অন্যান্য দিনের মতো গেটের বাইর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি ১৩ মাস গেটের বাইরে ঠাই দাড়িয়ে থাকা সেই শিশু শিক্ষার্থী নাঈম উর রহমানকে।

গতকাল সকালে গেটের সামনে আসার পর গেটের দারোয়ান শিক্ষার্থী নাঈম ও তার পিতা আব্দুর রহমানকে স্কুলের গেটে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়। 

সরজমিন সকাল সাড়ে ১০টায় দেখা যায় দি বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম স্বয়ং শিক্ষার্থী নাঈমের হাত ধরে শ্রেণিকক্ষের দিকে নিয়ে যান। ইংলিশ মিডিয়ামের নার্সারি ক্লাসের সামনে আসার পর অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম নাঈম উর রহমানকে তার শ্রেণিকক্ষে বসিয়ে দেন। এর আগে সকালে ১০টার দিকে স্কুলের গেটের সামনে দেখা হয় নাঈমের পিতা আব্দুর রহমানের সাথে। 

এবিষয়ে তার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, গত সোমবার (১৩ নভেম্বর)  বিকেল ৫টা ৩৫মিনিটে আমার স্ত্রী ডা. নাদিরা খানম বরাবর বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্যাডে অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম প্রতিষ্ঠানের পিওয়নের মাধ্যমে আমার বাসায় একটি পত্র পাঠিয়েছেন। পত্রে উল্লেখ ছিল, ১৩ নভেম্বর অত্র প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গভর্নরস এর বিশেষ সভার আলোচ্যসূচি-২ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনার পুত্র নাঈম উর রহমানকে আগামীকাল ১৪ নভেম্বর তারিখ হতে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার অনুমোদন দেওয়া হলো। আপনার পুত্রকে আগামীকাল ১৪ নভেম্বর ২০২৩ হতে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। 

স্কুল থেকে লিখিত পত্র পাওয়ার পর আমি আমার সন্তানকে নিয়ে আজ স্কুলে আসি। স্কুলের আসার পর প্রথমে আমার ছেলেকে অধ্যক্ষের কক্ষে নিয়ে যাই এবং অধ্যক্ষ স্যরকে আমি একটি লিখিত আবেদন দিয়ে রিসিভি কপিতে স্বাক্ষর নেই। প্রিন্সিপাল বরাবর আবেদনে আমি উল্লেখ করি,  আপনার পত্রের মাধ্যমে যার স্মারক নং দিবারেমসক/০১, ১৩/১১/২০২৩ তারিখে জানতে পারলাম যে, ১৩/১১/২০২৩ তারিখে অত্র প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গভর্নরস এর বিশেষ সভার আলোচ্যসূচি-২ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমার পুত্র নাঈম উর রহমানকে ১৪/১১/২০২৩ তারিখ হতে দীর্ঘ ১৩ মাস ২৫ দিন (১৯/০৯/২০২২)  থেকে ১৩/১১/২০২৩ পর) ১৪ নভেম্বর তারিখ হতে পুনরায় শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার অনুমোদন দেওয়া হয়। এখানে ডিটেইলস কোনো উল্লেখ নেই, নাঈম উর রহমান কোন শ্রেণিতে ক্লাস করবে? তাকে নতুন করে ভর্তি করতে হবে কিনা? দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাসের ব্যবধানে স্কুলের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যেমন-বই, খাতা, ক্লাস রুটিন ও ডাইরি। স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে আমি নাঈম উর রহমান এর পিতা আব্দুর রহমান আমার সন্তানকে ১৪ নভেম্বর তারিখে স্কুলের শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার জন্য নিয়ে আসলাম।আমি আপনাকে বিশেষ অনুরোধ করবো এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা বা ছাত্রছাত্রী দ্বারা আমার সন্তান যেনো কোন প্রকার বুলিং, রেগিং বা প্রতিশোধের শিকার না হয় বিষয়টি আপনি এবং স্কুল র্কতৃপক্ষ সদয় দৃষ্টি রাখবেন।

এর আগে গত ৮ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের ১১জন আইনজীবী শিশু নাঈমকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন।

ওই নোটিশে বলা হয়েছে, গত ৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ আইনজীবীদের নজরে আসে। সংবাদটির শিরোনাম ছিল— ‘প্রতিদিন স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থাকে শিশু নাঈম’। সংবাদটির সবচেয়ে অমানবিক ও হৃদয়বিদারক দিকটি হলো এক বছরের বেশি সময় ধরে শিশু নাঈম প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের পোশাক পরে। এরপর স্কুলব্যাগ নিয়ে তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলের গেট পর্যন্ত আসে কিন্তু গেটে তাকে আটকে দেওয়া হয়। তার সহপাঠী ও অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে বা টিফিনের সময় মাঠে খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে, তখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বিষন্ন মনে তা দেখছে নাঈম। স্কুল ছুটি পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলের প্রধান গেটে। ছুটি হলে ভাইয়ের সঙ্গে বাসায় ফিরে যায়। গত এক বছর ধরে চলছে এমন ঘটনা। নাঈমের যমজ ভাইয়ের জন্য স্কুলের প্রধান ফটক উন্মুক্ত হলেও নাঈমের জন্য ফটকটি বন্ধ রয়েছে ১৩ মাস ধরে। বিধি মোতাবেক স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও বেতন পরিশোধ করলেও সে স্কুলের উপযোগী নয়, কথা বলতে পারে না, পেন্সিল ধরতে পারে না ও দুষ্টামি করে এমন অজুহাতে তাকে অনেকটা অবাঞ্ছিত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ; যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের প্রতি অবমাননা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন। ঘটনাটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কলেজ সড়কে অবস্থিত দ্য বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের। শিশু নাঈম ও তার যমজ ভাইকে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ওই স্কুলে নার্সারি বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করা হয়। স্কুলের অধ্যক্ষসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট ভর্তি কমিটি তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ওই বছরের জুন মাস পর্যন্ত তারা শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেয়। পরে জুলাই মাসে তাদের ওই স্কুলেরই ইংলিশ মিডিয়ামে পুনরায় ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। পরে তারা একসঙ্গে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেয়। ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে নাঈমকে ক্লাসে এমনকি স্কুলেও ঢুকতে দেওয়া হয় না। নাঈমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সে স্কুলের উপযোগী নয়, কথা বলতে পারে না ও পেন্সিল ধরতে পারে না। এর আগে প্রায় দিনই শ্রেণিশিক্ষক কৃষ্ণা সূত্রধর নাঈমের ডায়েরিতে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য লেখেন; যা শিশুটির ওপর মানসিক নির্যাতনের শামিল। নোটিশে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে শিশুটির বাবা অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো তার সন্তানকে নিয়ে নানা ধরনের আপত্তিকর কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে নাঈমের বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। বরং শিশুটির বাবার এমন তৎপরতার কারণে অধ্যক্ষ তাকে পত্র পাঠিয়েছেন নাঈমের টিসি নেওয়ার জন্য। শিশুটির অসহায় বাবা ব্যবসায়ী মো. আব্দুর রহমান ও মা ডা. নাদিরা খানম দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন প্রায় বছরখানেক ধরে; কিন্তু কোনোভাবেই বিষয়টির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। দ্য বাডস রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন কার্যক্রম বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছে। তাই দেশের সচেতন নাগরিক এবং উচ্চাদালতের আইনজীবী হিসেবে এ আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশ প্রেরণকারী অন্যান্য আইনজীবীরা হলেন- জোবায়দুর রহমান, মোহাম্মদ মিসবাহ উদ্দিন, আল রেজা মো. আমির, রেজাউল ইসলাম, কে এম মামুনুর রশিদ, আশরাফুল ইসলাম এবং শাহীনুর রহমান, মোহাম্মদ হারুন, গোলাম কিবরিয়া ও বেলায়েত হোসেন সুজা। 

এ ব্যাপারে বাডস রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি জানান যেহেতু বিষয়টি সুরাহা হয়েছে, এখন এ বিষয় নিয়ে আর কি কথা বলবো। আমাদের চিন্তা কিভাবে শিশু নাঈমকে পড়ালেখায় অগ্রসর করা যায়। তাই আমি ক্লাস টিচারসহ সংশ্লিষ্টদের বলে দিয়েছি নাঈমকে বিশেষ কেয়ার করতে, যাতে লেখাপড়ায় উন্নতি করতে পারে।

মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার ফজলুর রহমান বলেন, শিশু নাঈমকে ক্লাসে ফেরাতে গত পরশু দিন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আমরা বসেছিলাম। শ্রীমঙ্গল উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা দীলিপ কুমার বর্ধন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ইউএনও আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুনসহ সংশ্লিষ্টরা। মিটিংয়ের মাধ্যমে আমরা বাডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলমকে নির্দেশ দিয়েছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেনো শিশু নাঈমকে ক্লাসে ফেরানো যায় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। আর ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অধ্যক্ষকে শোকজ করে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। তবে আজ শিক্ষার্থী নাঈম ক্লাসে ফিরেছে। নাঈমের ঘটনার পেছনে কি কারণ তা  মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও আমরা পরে দেখবো, আগে আমরা চাচ্ছি সে ক্লাসে অংশগ্রহণ করুক, আর সেটাই হয়েছে। এখন অধ্যক্ষ শোকজের জবাব দিবেন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে। এরপর এবিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিবেন।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, নাঈম যেনো কোনোভাবেই তার পড়ালেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, এ জন্য যা করার দরকার সর্বোচ্চটুকু করেছি। জেলা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিষয়টি সুরাহা করতে পেরেছি। ভালো খবর হচ্ছে শিশু নাঈম আজ থেকে ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে।

প্রসঙ্গত,  গত ৮ নভেম্বর শিশু শিক্ষার্থী নাঈম উর রহমানকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে ও তার ওপর চলমান মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করতে সুপ্রিমকোর্টের ১১ জন আইনজীবী শিক্ষা সচিব, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন।  সাত কর্মদিবসের মধ্যে শিশু নাঈমের ওপর চলমান অমানবিক ও মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করতে এবং তাকে ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার নোটিশে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। অন্যথায় নোটিশদাতারা উচ্চ আদালতের দারস্থ হবেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024