◾শেখ আব্দুল্লাহ : মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক গন্ডি পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পাবলিক, মেডিকেল, ইন্জিনিয়ারিং বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়ার জন্য স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকেন। এইচএসসি পরিক্ষার কিছুদিন বাদে শিক্ষার্থীরা বিশ্বিবদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার মাঝেই হাতে পেয়ে যায় তাদের এইচএসসি পরিক্ষার ফলাফল। যেসব শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পায় বা তার কাছাকাছি ফলাফল করে তাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়; প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মিষ্টি ছাড়াছাড়ি শুরু হয়ে যায়। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বুঝানো হয় তোমরাই এদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী শিক্ষার্থী; তোমাদের জন্যই পাবলিক - মেডিকেল বিশ্বিবদ্যালয় গঠিত।

 অপরদিকে যে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৪ বা তার থেকে কম ফলাফল করে থাকে, তাদেরকে বিবেচনা করা হয় দেশের কম মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে; ধরে নেওয়া হয় এসব শিক্ষার্থীদের দ্বারা উদ্ভাবনী কিছু করা সম্ভব নয়। খারাপ ফলাফল করার কারনে পরিবার ও সমাজ থেকে তাদের মানসিকভাবে চাপ দেওয়া হয়। শুধু পরিবার ও সমাজ থেকে খারাপ ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের হেও প্রতিপন্ন করা হয়না, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্ম কিনতে গেলে বুঝিয়ে দেয় তোমরা উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য যোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ফর্মে এসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে মোট জিপিএ-র অতিরিক্ত মার্ক চাওয়া হয়। ফলে অতিরিক্ত জিপিএ শর্ত পূরণ করতে না পেরে প্রতিবছর হাজারও শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায়। 

স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গনতন্ত্র ’ মতো একধরনের জিপিএ শর্তের ট্যাগ বসিয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্বিবদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।


একজন শিক্ষার্থী চিত্র অংকনে বেশ দক্ষ। কিন্তু গনিত ও ইংরেজিতে কাচা থাকার কারনে জিপিএ ভালো আসেনি। সে চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে তার প্রতিভাকে আরো প্রস্ফুটিত করতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির আবেদন ফর্মে অতিরিক্ত জিপিএ শর্ত থাকার কারনে ফর্ম কিনতে পারিনি। ফলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। 

অপরদিকে একজন শিক্ষার্থী খেলাধুলা, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, চিত্র অংকন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক বা সৃজনশীল কাজ কোনোটিতেই পারদর্শী নয়, কিন্তু গনিত ও ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। দেশের প্রচলিত বই গলত করতে করতে এখন সে যেকোনো কঠিন অংকের সমাধান করতে পারে। ফলস্বরূপ তার এসএসসি ও এইচএসসি রেজাল্ট অনেক ভালো হয় এবং জিপিএ শর্ত পূরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা চান্স পেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়।

আবার, এ দুটি উদাহরণ দ্বারা কখনো বিচার করা যাবে না যে জিপিএ ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা কোনো সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বা পড়াশোনা বাদে অন্য কোনো প্রতিভাবান কাজ জানে না, বরঞ্চ জিপিএ ভলো করা শিক্ষার্থীরা বইয়ের জ্ঞান ও বাইরের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টিতে এগিয়ে থাকেন।

 অপরদিকে জিপিএ-৪ বা তার থেকে কম পাওয়া শিক্ষার্থীরা অনেক প্রতিভাবান শক্তির অধিকারী এটা বলা যাবে না। এদের ভিতর অনেক শিক্ষার্থী আছে বাবা-মায়ের অবাধ্য, পড়াশোনা ঠিকমতো করতে চাইনা, সৃজনশীল কাজে মন না দিয়ে সারাদিন ভিডিও গেইমস নিয়ে পড়ে থাকেন। ফলস্বরূপ পরিক্ষায় খারাপ ফলাফল করে। তাই এ থেকে বোঝা যায় জিপিএ দিয়ে একটা শিক্ষার্থীকে কখনো মূল্যায়ন করা যায় না। 

কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবেদন ফর্মে অতিরিক্ত জিপিএ ট্যাগ করে জিপিএ কম পাওয়া শিক্ষার্থীদের কোনঠাসা করে রাখে। জিপিএ-র মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে ছেঁকে ছেঁকে বেশি জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিশ্বিবদ্যালয়ে পরিক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। 


বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে একজন শিক্ষার্থী প্রথম লক্ষ্য থাকে মেডিকেল বা ইন্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করা। কিন্তু প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত জিপিএ মার্ক চাওয়ার কারনে হাজারো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ফর্ম কিনতে ব্যার্থ হয়। ফলে মেডিকেল- ইন্জিনিয়ারিং পড়া স্বপ্ন মাথা থেকে নামিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ধাবিত হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফর্ম কিনতে এসে দেখে এখানেও জিপিএ-র শর্ত জুড়ে দেওয়া। জিপিএ-র শর্ত অনুযায়ী কোথাও আবেদন ফর্ম কিনতে পারছে আবার কোথাও পারছে না। ঠিক এমনভাবে ভুক্তভোগী মানবিক ও ব্যাবসা শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। 


শিক্ষার্থীরা চাইনা যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্ষার আবেদন ফর্মে জিপিএ শর্ত একবারে না দেওয়া হোক; শিক্ষার্থীরা চাই জিপিএ শর্ত কিছুটা শিথিল করা হোক, যাতে করে আরো কিছু উদ্ভাবনী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফর্ম কেনার সুযোগ পাই। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন ফর্ম কেনার জন্য নোটিশ প্রকাশ করেছেন। নোটিশে আবেদনের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি মিলেয়ে মোট জিপিএ-৮, মানবিক বিভাগ থেকে মোট জিপিএ-৭.৫, ব্যবসা বিভাগ থেকে মোট জিপিএ-৭.৫। তাতে করে অনেক শিক্ষার্থীই পরিক্ষার ফর্ম কিনতে পারবে না। নোটিশে উল্লেখিত জিপিএ শর্ত যাদের কম রয়েছে তাদের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্ষা দিয়ে নিজেকে যাচাই করার একটা বারের মতো সুযোগ হলো না। তাই ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় সহ অন্যাঅন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত জিপিএ শর্ত কিছুটা শিথিল করে আরো কিছু উদ্ভাবনী শিক্ষার্থীদের বিশ্বিবদ্যালয়ে পরিক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।  



শেখ আব্দুল্লাহ 

লেখক ও শিক্ষার্থী


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024