|
Date: 2023-12-09 05:24:58 |
অনেকক্ষণ ধরে মাহমুদ এসে দরজা নক করছে আর বলছে,
- ভাইয়া,ও ভাইয়া। তাড়াতাড়ি দরজা খুল। দেখ না আম্মুর ফোন কেন জানি অফ হয়ে গেছে। আর খুলছে না। একটু ঠিক করে দে না।
(মাহমুদের কথার জবাব দেওয়ার মতো কোনো প্রকার শারীরিক সামর্থ আমার নেই)
- ভাইয়া রে,ও ভাইয়া। আর কতক্ষণ রাগ করে থাকবি? আব্বু-আম্মু বসে আছে টেবিলে। আয়,একসাথে খাবো।
ফ্যানের সাথে ঝুলে আছি আমি। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে অবিরাম ব্যাথা করছে। তিলে তিলে আমি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। তাই মাহমুদের কথার জবাব দিতে পারছিনা।
দুই ঘন্টা আগে অন্য আট-দশটা ছেলের মতো আমিও হাসিখুশি একটা ছেলে ছিলাম। পরিক্ষার রেজাল্ট শোনার পর হাসিখুশি এই আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাসায় আসতে ইচ্ছা করছিল না। ইচ্ছে করছিল দূরে কোথাও পালিয়ে যাই যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না, জিজ্ঞেস করবে না আমার রেজাল্ট কি।
বাসায় ফেরার পথে খেয়াল করলাম দোকানদার আঙ্কেল ও পাশের বাসার আন্টি আমার দিকে আঁড় চোখে তাকাল। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে উনারা আমার রেজাল্ট জেনে গেছেন। উনারা জেনে গেছেন যে আমি ফেইল করেছি। কিন্তু তারপরও কেন জানি আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
- মেহেদী, শুনলাম এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। তোমার রেজাল্ট কি?
আমি কেবল মাথা নিচু করে বাসায় ঢুকে পড়লাম। আর কি বা বলার ছিল আমার? আমি কি বলতাম যে আমি ফেইল করেছি? আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজের ব্যার্থতা ও অকৃতকার্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করা।
বাসায় ফিরে আব্বু-আম্মুর বকাবকি শুনতে হলো। আব্বুর এক এক ঝাঁড়ি যেন আমাকে ভেঙ্গে তচনচ করে দিয়েছে। রাগ করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এর আগেও অনেকবার রাগ করে দরজা বন্ধ করেছিলাম এবং রাগ কমার পর আবার দরজা খুলে বেহায়ার মতো সবার সাথে কথা বলেছিলাম। কিন্তু এইবার বিষয়টা অন্যরকম হলো। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। একা হয়ে গেলাম। কেউ নেই আমার কষ্টের ভাগ নেওয়ার, একটু সান্ত্বনা দেওয়ার। যন্ত্রণায় ইচ্ছে করছে মাথার চুলগুলো চিঁড়ে ফেলি। সম্পুর্ণ পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিকে। মাথায় কত যে চিন্তা বাসা বেঁধেছে। আব্বু-আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। ছোটভাইয়ের সামনে লজ্জিত হলাম। আব্বু-আম্মুর মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিলাম। এসব ভাবতে ভাবতে আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সবাইকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই ভাবা সেই কাজ। নিথর শরীরটা ঝুলছে ফ্যানের সাথে। আমি আর আমাতে নেই।
গত দুই ঘন্টায় আমার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আব্বু-আম্মু ভীষণ চিন্তায় পড়লেন। আমি এখন তাদের মনের কথা গুলো শুনতে পাচ্ছি। আব্বু মনে মনে বলছেন আমাকে বকাবকি করা তার একদম উচিত হয়নি। পরিক্ষায় ভালো করলে আমাকে একটা স্মার্ট ফোন গিফট করবেন বলেছিলেন। ফোন কিনেও রেখেছিলেন। কিন্তু আমি তো ফেইল করেছি। তাই ফোনটা আমার ভাগ্যে নেই। কিন্তু আব্বু মনে মনে বলছেন আমি ফেইল করেছি তবুও তিনি ফোনটা আমাকে দেবেন। আমি রুম থেকে বের হলেই তিনি দিয়ে দিবেন।
মৃত্যুর আগে যদি জানতে পারতাম আব্বু আমাকে এতোটা ভালোবাসেন তাইলে আমি কখনোই আত্মহত্যার পথে পা দিতাম না। খুব আফসোস হচ্ছে এখন।
আম্মু কাঁদছেন…। আর মনে মনে বলছেন আমাকে বকা তার উচিত হয়নি,আমাকে আর বকবেন না। আমার জন্য আজকে বিরিয়ানী রান্না করেছিলেন আন্মু। তিনি ভাবছিলেন রুম থেকে বেরিয়ে আসলেই আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবেন। কিন্তু সেই ভাগ্য আর হল কই।
এসব দেখে আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলাম।
দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আমার লাশ নামানো হলো। খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শেষ বারের মতো দেখতে বন্ধুরা সবাই আসলো। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আমার অবুঝ ভাইটা। বার বার বলছে,
- ভাইয়া, তুই ফিরে আয়।। আমি আর কখনো তোকে বিরক্ত করবো না, জালাবো না।
আম্মু অজ্ঞান হয়ে গেছেন। চারপাশে কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনা যাচ্ছে না। আমার জন্য সবাইকে এভাবে কান্না করতে দেখে আমি বুঝালাম যে সবাই আমাকে ভালোবাসে। এই দেখে আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকলেও আমি শত চেষ্টা করে জীবিত হতে পারবোনা। আমার জন্য সবারই ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু আফসোস , জীবিত অবস্থায় তা আমি বুঝিনি। এখন বুঝেও লাভ নেই।
আত্মহত্যা কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আত্নহত্যা করার পর আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত এক হাজার বার ভাবুন। ভালোবাসুন মা-বাবাকে,ভালোবাসুন পরিবারকে। জীবটা অনেক সুন্দর। উপভোগ করুন সুন্দর জীবন। দুঃখের পরে অবশ্যই সুখের স্থান আছে।
লেখক: তোপাজ্জল হক মেহেদী
শিক্ষার্থী : ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ
© Deshchitro 2024