|
Date: 2023-12-18 07:02:47 |
মোঃ আজগার আলী, সদর উপজেলা সাতক্ষীরাঃ
“কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছেন লতাটা,
সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা, আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি, খোকা, তুই আসবি কবে?”
শীতের মৌসুমে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন
এলাকায় কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়েছে। এটি একটি অনন্য খাবার মজাদার কুমড়া বড়ি। সাধারণত
তরকারিতে এই কুমড়া বড়ি দেয়া হয়। এতে তরকারির স্বাদ ও মান বৃদ্ধি পায়। চলমান শীতে কুমড়া
বড়ি তৈরী কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে শহর এবং গ্রামের অনেক নারীরা। কিছুকিছু স্থানে তাদের
সাথে যোগ দিচ্ছে পুরুষরাও। জানা গেছে, বিভিন্ন
এলাকায় কুমড়া বড়ি তৈরীর ধুম পড়েছে। বহু নারী কুমড়া বড়ি তৈরীর কাজে জড়িত রয়েছেন। নিজেদের
পরিবারের খাবারের জন্য এটি তৈরি করছেন।
আবার কিছুকিছু এলাকায় বিক্রির জন্যও
কুমড়া বড়ি প্রস্তুত করা হচ্ছে। আবার এই শীত মৌসুমে বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে অনেক নারী ও
পুরুষ কুমড়া বড়ি তৈরি করছেন। কুমড়া বড়ি তৈরি কাজে নিয়োজিত কয়েকজন নারী জানান, শীতকাল
কুমড়া বড়ি তৈরীর ভরা মৌসুম। এ সময় প্রায় প্রতিটা বাড়িতে কমবেশি কুমড়া বড়ি তৈরি করা
হয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করাও হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের
নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য কুমড়া বড়ি তৈরী করছেন। তারা জানান, কুমড়া বড়ি তৈরীর প্রধান
উপকরণ কলাইয়ের ডাল আর চাল কুমড়া। এর সাথে লবনসহ সামান্য মসলা।
বাজারে প্রতি কেজি কলাই ডাল ১৩০ থেকে
১৫০ টাকা আর চাল কুমড়া ২৫থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাইজ হিসেবে চাল কুমড়া
১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ক্রয় করা যায়। প্রতি কেজি কলাই ডালের সাথে ৩কেজির মতো কুমড়ার
মিশ্রণে কুমড়া বড়ি ভালো হয়। প্রথমে কলাই ডাল রৌদ্রে শুকিয়ে যাতায় ভেঙ্গে পরিস্কার করা
হয়। সেই ডাল পানিতে ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। সাধারণত সন্ধ্যা থেকে রাতভর অর্থাৎ
প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে শিল-পাটায় সেই ডাল বাটা হয়।
আর চাল কুমড়া পিচ করে কেটে কুড়নিতে ঘষে
মিহি করা হয়। এরপর দুইটির মিশ্রণ হাত দিয়ে ফেনিয়ে কুমড়া বড়ির উপকরণ তৈরী করা হয়। মাঠ,
বাড়ির আঙ্গিনা, ছাঁদ বা খোলা জায়গায় পরিষ্কার কাপড় বা নেটে ভোর থেকে হাত দিয়ে বড়ি বসানো
শুরু করা হয়। পাতলা কাপড়ে সারি সারি বড়ি বসানোর পর সেই বড়ি ৩/৪ দিন একটানা রৌদ্রে শুকানো
হয়। বড়ি শুকিয়ে গেলে কাপড় থেকে বড়ি উঠিয়ে পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। তারা আরো বলেন, তবে
এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুমড়া বড়ি তৈরীর মেশিনেও মাড়াই করে কলাই ডাল ও কুমড়ার মিহি
করা হচ্ছে। পৌর সদরের সাজিদা বেগম ও সালমা খাতুন জানান, ৩কেজি কুমড়ার সাথে ১ কেজি কলাইয়ের
ডাল মিশ্রণে কুমড়া বড়ি ভাল তৈরি হয়।
এখন বাজারে খোসা ছাড়ানো কলাই ডাল পাওয়া
যায়। ডাল ভালো হলে বড়ির স্বাদও ভালো হয়। এ ছাড়াও অনেকে কুমড়া বড়ির সাথে পেয়াজ মিশ্রন
দিয়ে থাকেন। প্রতি কেজি ডালের হিসেবে কুমড়া বড়ি তৈরি করতে পারিশ্রমিক হিসেবে ১০০ টাকা
করে নেয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রতি কেজি ডালের হিসেবে কুমড়া বড়ি তৈরি করতে আনুমানিক ২৭০
থেকে ২৮০ টাকা খরচ হচ্ছে। আর বাজারে ৩’শ টাকার উপরে কুমড়ার বড়ি বিক্রি হয়। এতে পরিবারের
চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয় করা সম্ভব হচ্ছে। অনেকে জানান, কুমড়া বড়ি তরকারির একটি মুখরোচক
উপাদান। এতে তরকারির স্বাদে যোগ হয় নতুন মাত্রা। শীত মৌসুমে কুমড়া বড়ি তৈরী করে অনেক
নারীদের বাড়তি আয়ের সুযোগ হচ্ছে। তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিজেদের
ভাগ্যোন্নয়ন গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
শীতকালের উপাদেয় খাবার কুমড়ো বড়ি। ডালের
আটার সাথে পাকা চালকুমড়ো ভাল করে ফেনিয়ে মিশিয়ে তৈরি করা কুমড়ো বড়ি শৈল, টাকি টেংড়াসহ
বিভিন্ন মাছের সাথে তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। শীতের সময় বউ শ্বাশুড়ি মা বোনেরা বাড়িতে
খাবার জন্য এ বড়ি তৈরি করেন। অনেকে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন।
মুখরোচক হওয়ায় ভোজন রসিকরা বাজার থেকে কুমড়ো বড়ি কিনে খান। দীর্ঘ বছর যাবত এলাকার প্রায়
শতাধিক পরিবার কুমড়ো বড়ি তৈরি করে বাজার জাত করে আসছেন। সম্প্রতি কথা হয় কয়েকজন কুমড়ো
বড়ি তৈরির কারিগরের সাথে।
পৌর সদরের মহল্লার গৃহবধু আদুরী ভৌমিক
বলেন, “বিশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিবছর প্রায় চার পাঁচ মাস আমরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করে
বিক্রি করে আসছি। খেশারী, ছোলা, এ্যাংকর ডাল ভিজিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে মিল থেকে পিষে
আনি। এরপর খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এগুলি পাকা কুমড়ো দিয়ে ভাল করে ফেনিয়ে পলিথিনের প্যাকেটে
ভরে পলিথিনের নিচের দিকের কোনা পরিমান মতো কেটে সে অংশ দিয়ে টিনের তৈলাক্ত মাচায় বড়ি
দেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কুমড়ো বড়ি রোদে শক্ত হয়ে গেলে উল্টিয়ে দেই। এর পর দুই তিন ঘন্টা
পর পর নেড়ে দেই যেন সব অংশে সমানভাবে রোদ পায়। ভালো রোদ হলে দুই তিন দিনে শুকিয়ে যায়
কুমড়ো বড়ি। শুকোনোর পর বাড়ির পুরুষ সদস্যরা সেগুলো পার্শ্ববর্তী বাজার, রেলবাজারসহ
স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা এ্যাংকর ডালের বড়ি
১৫০ টাকা, খেশারী ডালের বড়ি ১৮০ টাকা থেকে ২শ টাকা এবং ছোলার ডালের বড়ি ২শ থেকে ২শ’
২০ টাকায় বিক্রি করি। আমার স্বামী ফলের ব্যবসা রয়েছে। আমরা বাড়িতে এ কাজগুলো বাড়তি
কিছু আয় আসে যেটা পরিবারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাছাড়া বিভিন্ন কাজে নিজেদের ও তো পয়সার
দরকার হয়। সব সময় তো চাওয়া যায় না। তাই সংসারে বাড়তি স্বচ্ছলতা ও নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর
জন্য আমরা কুমড়ো বড়ি তৈরী করে থাকি।’
বয়স হলেও ঘরে বেকার বসে থাকা ভালো লাগে
না। তাই আশ্বিন থেকে মাঘ এ পাঁচ মাস কুমড়ো বড়ি তৈরি করি। ছেলে হাট বাজারে এগুলো বিক্রি
করে। এতে বাড়তি কিছু আয় আসে। সংসারে অনেক খরচ। এ বাড়তি আয় টুকু সংসার পরিচালনায় সহায়ক
ভূমিকা রাখে।’ প্রতিকূলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ডাল ভিজিয়ে পেষার পর অথবা কুমড়ো বড়ি
দেওয়ার পর দুই তিন দিন এক নাগারে বৃষ্টি হলে সব বড়ি পঁচে যায়। তখন আমাদের অনেক ক্ষতি
হয়ে যায়।
খুলনায় সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত
সময় পার করছেন কারিগররা। শীত মৌসুমে এই বড়ির চাহিদা বেশি থাকায় এখন এই বড়ি তৈরি নিয়ে
চলছে শহরে প্রতিযোগিতা। অর্ধেক রাত থেকে শুরু হয় এই বিখ্যাত বড়ি তৈরির কাজ। নিজ জেলার
প্রয়োজন মিটিয়ে চালান হচ্ছে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে।
সূত্রে জানা গেছে, জেলার নিজস্ব একটি
ঐতিহ্যপূর্ণ খাবার হলো এই মাসকালাইয়ের কুমড়া বড়ি। এটি শীত মৌসুমের একটি বিশেষ খাবার।
শীতের ৬মাসই মূলত এই বড়িটি তৈরি করা হয়ে থাকে। দিন দিন এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। রয়েছে
অধিক মানের পুষ্টিগুন। বড়ি তৈরির সব উপকরণই পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার পণ্য। তাই এই বড়িতে
ভেজাল বলে কিছুই নেই। শীত মৌসুমে যে কোন তরকারিতে এই কুমড়া বড়ি যোগ করে আলাদা একটি
স্বাদ। দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও
ও জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই কুমড়া বড়ি চালান হয়ে থাকে। তবে সম্প্রতি বড়ি তৈরির
প্রধান উপকরন মাসকালাইসহ নানা উপকরনের দাম বেড়ে যাওয়া এবং স্বল্প সুদের ঋণ না পাওয়াসহ
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই শিল্পটি থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যদি সরকারি
ভাবে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের সহযোগিতা প্রদান করা হয় তাহলে আগামীতে এই কুমড়া বড়ি দেশের
সকল স্থানে চালান করা সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
আরেক কারিগর কৃষ্ণ কুমার বলেন আমরা প্রকার
ভেদে প্রতি কেজি বড়ি ১৫০-৪০০টাকায় খুচরা-পাইকারি বিক্রয় করি। দ্রুত এই শিল্পের সঙ্গে
জড়িতদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানসহ অন্যান্য সরকারি সহায়তা প্রদান করে এই শিল্পটিকে আধুনিকায়ন
করা হলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অনেক অর্থ রাজস্ব হিসেবেও আয় করতে পারেন।
পাশাপাশি সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই কুমড়া বড়িটি বিদেশেও চালান করা সম্ভব।
প্রতি বছরের মত যশোর জেলাসহ গোটা উত্তরাঞ্চল
জুড়ে মাসকলাই ও কুমড়োর বড়ি তৈরিতে হাজার হাজার বউ, শাশুড়ি, মা, বোনেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
শীত মৌসুমের শেষ সময়ে মাসকলাইয়ের ডালের আটা ও পাঁকা চাল কুমড়ো মিশিয়ে এ সুস্বাদু বড়ি
তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলের নারীরা শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কয়েক মাস পূর্বে
থেকে চাহিদা মত চাল কুমড়ো পাঁকানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। নতুন কলাই জমি থেকে ঘরে, বাজারে
আসার সাথে সাথে বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। এ সব এলাকার ৮০ ভাগ মহিলারা পালা করে বড়ি দেয়ার
কাজটি করে থাকেন। মিশ্রণ ঠিকভাবে হয়েছে কি না তা দেখার মহিলারা মাঝে মাঝে বড়ির আকৃতি
করে পানির পাত্রে ছেড়ে দিলে তা যদি ডুবে যায় তবে আরও ফেনাতে (নাড়াচাড়া করতে) হয়, আংশিক
ভাসলে বড়ি তৈরি উপযোগী হয়েছে বলে তারা মনে করেন। ২/৩জন মহিলা সুতি মশারী কিংবা প্লাস্টিকের
জ্বাল দড়ির খাটের উপর বিছিয়ে দিয়ে এর উপর ওই মিশ্রণ বড়ি আকৃতি করে লাইন করে দেয়া হয়।
৫/৬ দিন ভাল করে রোদে শুকাতে হয়। মেঘলা ও ঘন কুয়াশা থাকলে বড়ি গন্ধ ও লাল হয়ে যায়।
সে গুলি সহজে সিদ্ধ হয় না। খেতেও ভাল লাগে না। ভালোভাবে শুকিয়ে মুখ আটানো পাত্রে সংরক্ষণ
করলে ১২ থেকে ১৪ মাস পর্যন্ত খাওয়া যায়। বড়ির উপকরণের মূল্য বেশি হওয়ায় বড়ি তৈরিতে
এখন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড়ি তৈরি করে বিভিন্ন বাজারে হাটে
বিক্রি করে জীবন-জিবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে বড়ির উপকরণের লাগামহীন
মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা বড়ি তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বড়ির সাথে ইলিশ মাছ, চিংড়ি
মাছ, বেগুণ, হাঁস, মুরগীর ডিম বেশ মজাদার খাবার। বড়িকে এককভাবে রান্না করে খাওয়া যায়।
বিদেশে বড়ি এখন বেশ জনপ্রিয়। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের নিকট বিদেশে বড়ি পাঠাচ্ছেন এবং বিদেশে
পাড়ি দেয়ার সময় তরকারি হিসেবে বড়িকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে
একজন এমবিবিএস ডাক্তার এ প্রতিবেদককে জানান, বড়ির পুষ্টি গুণ অনেক বেশি, পেটের জন্য
বেশ উপকারী, রুচি সম্মতভাবে খাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে থাকেন।
মেহেরপুরে গৃহবধূরা কুমড়ার বড়ি বানাতে
এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এই শীতে প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে কলাই আর চালকুমড়া দিয়ে বড়ি
বানানোর মহোৎসব। আর এ বড়ি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে ভারতসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন
দেশে। মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামের কয়েকশ’ পরিবার এখন কুমড়া বড়ি তৈরি করে তা বাজারে
বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
তহুরা খাতুন জানান, এ বড়ি মধ্যবিত্ত
ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য মাছ-মাংসের সমান। শীত এলেই গ্রামাঞ্চলের লোকজন বড়ি তৈরিতে
ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পাড়ার অনেক পরিবার একত্র হয়ে আমরা বড়ি বানাই। ধনী-গরিব সবাই এই বড়ির
প্রতি দুর্বল। কেননা বড়ি প্রতিটি তরকারিতে বাড়তি স্বাদ এনে দেয়। বড়ি ভেঙে পেঁয়াজ, রসুন
ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাঁজি করলে চমৎকার খাবার তৈরি হয়। এছাড়া বড়ি দিয়ে রান্না করা বেগুন,
লাউ, ফুলকপি, আলু প্রভৃতি তরকারির যেন স্বাদই আলাদা। তবে একাজে ঝামেলাও অনেক পোহাতে
হয়। শীতের মৃদু রোদে বড়ি শুকানো বেশ ঝামেলার কাজ বলে নারীরা মনে করেন। তারপর যদি আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন হয় তাহলে তো চিন্তার শেষ নেই। কারণ বড়ি যথাযথ রোদ না পেলে প্রকৃত স্বাদ
নষ্ট হয়ে যায়।
মেহেরপুর শহরের কাজি অফিসপাড়ার গৃহবধূ
মনিরা আক্তার জানান, প্রতিবছর শীত এলে শহর ও গ্রামগঞ্জের সব পরিবারে অন্য কোনো কিছু
না হলেও বড়ি হতে হবে। তাই ঢেঁকি, যাঁতাকল কিংবা মেশিন যেখান থেকেই হোক না কেন বড়ির
উপকরণ প্রস্তুত করেন তারা। তিনি আরো বলেন, মেহেরপুরের তৈরি বড়ি শুধু এখানকার মানুষই
খায় না, এই বড়ি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। বিদেশিরা মেহেরপুরের বড়ি খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন।
মেহেরপুর শহরের কয়েকজন বড়ি ব্যবসায়ী
জানান, মূলত শীতের মৌসুমে `কুমড়া বড়ির` বাজার ধরতে আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই তিন
মাস তাদের পরিবারগুলো কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। তারা আরো জানান, ২-৩ দিন কড়া
রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় সুস্বাদু কুমড়া বড়ি।
সম্প্রতিক সময়ে ডাল ও মসলার দাম বৃদ্ধি
পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের কুমড়া বড়ি তৈরির ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় মেহেরপুরে কুমড়া বড়ি তৈরিতে নিয়োজিতরা জীবিকা নির্বাহের জন্য
স্বল্প সুদে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি করছেন।
ভেজা কলাই (মাষকলাই) ডাল পাটায় মিহি
করে পিষ ছিলেন চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাজরাহাটি মাঠপাড়ার রোজিনা বেগম। চাল কুমড়া কুঁচিয়ে
নিচ্ছিলেন ডালের পেস্টের সঙ্গে মেশানোর জন্য। একটি পাত্রে কুঁচানো চালকুমড়া আর বাটা
কলাই ডাল ভালো করে ফেটিয়ে নেন। টিনের ট্রে বা সমান টিনের পাত্রে নারিকেল তেল মেখে সারি
সারি কুমড়া ডালের বড়ি বসাতে থাকেন। এভাবেই তিনি পৌষ-মাঘ দু’মাস কুমড়া বড়ি দিয়ে তা কয়েকদিন
রোদে শুকিয়ে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।
এ প্রসঙ্গে রোজিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী
আরজুল্লাহ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। স্বামীর একার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আমি
কুমড়া বড়ি তৈরি করতে পারি। এই শেখাটাকে কাজে লাগিয়ে শীত মৌসুমে কিছু অর্থ উর্পাজনের
চেষ্টা করি। শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় এ সময়টায় আমি কুমড়ার বড়ি তৈরি করি। প্রতি কেজি
কুমড়া বড়িতে খরচ বাদ দিয়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা হাতে থাকে। এভাবে শীতকালে কুমড়ো বড়ি বিক্রি
করে কিছু টাকা সঞ্চয় করি। কারণ বর্ষা মৌসুমে স্বামীর কাজ-কাম থাকে না। আমার জমানো টাকা
তখন সংসারের প্রয়োজনে খরচ করি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের কোর্টপাড়ার রুবি
খাতুন দালানের ছাদে টিনের ট্রেতে কুমড়া বড়ি দিচ্ছিলেন। বয়স ৬০ বছর। রুবির মতে, ছেলেবেলা
থেকেই মা-দাদিদের দেখে আসছি কুমড়া বড়ি বানাতে। আগে ঢেঁকির ব্যবহার লাগত কুমড়ার বড়ি
তৈরিতে। পরবর্তীতে পাটার ব্যবহার করা হতো। এখন বাজারে ডাল ভাঙানোর মেশিন আছে। কলাইয়ের
ভেজানো ডাল নিয়ে গেলেই মুহূর্তে কলাইয়ের ডাল মিহি করে ঘুটে দেয়।’
একই পাড়ার ফরিদা খাতুন। তিনিও শীত মৌসুমে
কুমড়া বড়ি দেন। ফরিদা খাতুন বলেন, পাঁচ কেজি ওজনের একটা চালকুমড়ার সঙ্গে বড়ি দিতে এক
কেজি কলাইয়ের ডাল প্রয়োজন হয়। পাঁচ কেজি ওজনের একটি চালকুমড়ার সঙ্গে এক কেজি কলাইয়ের
ডাল মিশালে প্রায় দুই কেজি বড়ি তৈরি করা যায়।’ প্রতি কেজি কলাইয়ের ডাল মেশিন দিয়ে মাড়াই
করতে ৮ টাকা লাগে।
জানা যায়, আত্মীয়-স্বজনের হাত ঘুরে সুস্বাদু
কুমড়া বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালীদের রসনা তৃপ্ত করছে। এ জেলার মানুষ যারা সৌদি আরব, কাতার
ওমান, আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন
তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে
পরিচিতি পাচ্ছে এই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি।
অনেক নিন্মবিত্ত পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের
লেখাপড়ার খরচসহ জীবিকা নির্বাহ করেন কুমড়া বড়ি তৈরির ওপর ভিত্তি করে।
© Deshchitro 2024