অধিকাংশ ক্যাডারের লাইফেই একটা কামব্যাক স্টোরি আছে। চাকরির জন্য সর্বোচ্চ ক্ষুধার্ত মানুষটি বাদে এই চাকরিটি ভাগ্যে জোটেনা- তা বিসিএস প্রত্যাশী প্রতিটি মানুষই অন্তর দিয়ে অনুভব করেন। হাজারো স্মৃতিবহ এই যাত্রার কিয়দংশ লিপিবদ্ধ করে রাখছি; হয়তো আমার ভবিতব্য অনুজ সহকর্মীদের কিঞ্চিৎ অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে- এই আশায়।

অনার্স এবং পূর্বের কাহিনী :

আমার গল্পের শুরুটা হবে এসএসসি থেকে। মোটামুটি মেধাবী ছিলাম, এক সাবজেক্ট এর জন্য গোল্ডেন মিস করি '১১ সালে। অতঃপর এইচএসসিতে ভর্তি হই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। নতুন জীবন-নতুন রঙ, আর্থিক টানপোড়েন- সবমিলিয়ে বাস্তবতা থেকে ক্রমেই সরে পড়ি। ফলাফল ইন্টারমিডিয়েটে A+ মিস; এডমিশনে সেকেন্ডটাইমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থে ভর্তি হই।

১ম, ২য়, ৩য়- একে একে তিনটি বর্ষ পেরিয়ে যায় পড়াশোনায় অবহেলা নিয়ে। মানসিক দৈন্যতা কাটাতে আমার সময় লেগেছে তিনবছর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী কী পরিমাণ মানসিক হীনম্মন্যতা নিয়ে দিনাতিপাত করে- কেবল তারাই জানে। আগের হাজারো অর্জন থাকলেও, ক্রমশ তারা ফিকে হয়ে ওঠে বাস্তবতার কাছে। শুনতে হয় সবসময়ই, "এত ট্যালেন্ট দিয়ে কী করলি?" থাকে না উত্তর; মাথা তুলে তাকিয়ে কথা বলার মত শক্তিও হারিয়ে যায়। আমার পছন্দের একজন রিএডমিশন টাইমের শিক্ষক ছিলেন; একদিন সরকারি কলেজ মাঠে তার সাথে দেখা হয়। কোথায় চান্স পেলি, প্রত্যুত্তরে যখন বললাম ভাই ন্যাশনালে ফিজিক্সে চান্স পেয়েছি, শুনে এমনভাবে মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন- "আচ্ছা ঠিক আছে যা"- ঐটা আজও মনে আছে।

২০১৭ সালে এলাকায় ফ্লেক্সিলোড এর দোকান দেই এক পার্টনার ছোটভাইয়ের সাথে। তখন পড়াশোনায় ফুলটাইম নেগলিজেন্সি চলমান; সোজাসাপটায় বলতে গেলে দেখে দেখে পাস করি, পরীক্ষার হলে খাতা দেওয়ার প্রায়ই মিনিটদশেক মিনিট পরে ঢুকি। বিচ্ছিরি অবস্থা।

এরই মাঝে দৈবাৎক্রমে জীবনে একজন আসে। এর আগে আমার জীবনে কোন লক্ষ্য ছিল না। সে আসার পর ভাবলাম, তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিতে হলেও অনার্স পাশ করে বেরুতে হবে, একটা চাকরিও লাগবে। ততদিনে ২য় বর্ষের 'ক্যালকুলাস-২' সাবজেক্টে দু'বছর ফেল মারা হয়ে গেছে। আরেকবার ফেল মারলে পুরো ইয়ারের সাবজেক্ট রিটেক দিতে হবে; আমার জন্য মোটামুটি সর্বোচ্চমানের অশনি সংকেত। যখন এই চিন্তার উদ্রেক, তখন ৪র্থ বর্ষে পড়ছি। পাশাপাশি লস খেয়ে দোকান ছেড়ে দিলাম।

অগত্যা আমার এক বন্ধুর পরামর্শে ছোটভাইদের ব্যাচে ভর্তি হলাম ক্যালকুলাসের দরিয়া পেরোতে। মাসখানেক পড়লাম, দেখলাম যতটা কঠিন লাগত, ততটা কঠিন না। এক্সামে বসলাম।

এই এক্সামে প্রিপারেশন নিয়ে যাওয়ার দরুণ নিজে তো ভাল এন্সার করলামই, পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকজনকে হেল্প করলাম দরিয়া পেরোতে। এইটা আমার জীবনের মোস্ট ক্রুশিয়াল টার্নিং পয়েন্ট ছিল। দেখলাম যে আমি আজ ৩টা বছর সবারটা দেখে পাস করি, সেই আমি আজ অন্যদের হেল্প করছি পাস করতে! ভাবলাম, চাইলেই তো পারি- চেষ্টা করি না তাই!

সেই থেকে শুরু করলাম। ২য় বর্ষের ২টা সাবজেক্ট রিটেক কভার করলাম, ৩য় বর্ষে ২টা করলাম। সবশেষে যখন পড়ে রইল ৪র্থ বর্ষ- ভাবলাম এটাই বা পারব না কেন? একটানে এক বর্ষে ৩ বছরের জের টানলাম; ফার্স্টক্লাস সিজিপিএ নিয়ে বের হলাম অনার্স থেকে।

বিসিএস যাত্রা: (খুটিনাটি )

অত্যুক্তি বা মিথ্যাচার হবে না বললে- যে আমি অনার্স শেষের আগ পর্যন্ত বিসিএস সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ৪র্থ ইয়ার ভাইভা শেষে আমার ফ্রেন্ড ইফরান বলল, "নাভিদ বিসিএসের কোচিং করবা না?" "হ্যাঁ করতে হবে ভাই, চলো।" এই-ই শুরু।

এক-দুই কোচিং ঘুরে বুলবুল ভাইয়ের কাছে ভর্তি হলাম দু'জন। ভাই অসাধারণ মানুষ এবং শিক্ষক; তার গণিত ক্লাসে মন জুড়িয়ে যেত পড়ানো এবং বোঝানোর ধাঁচে। ভাইয়ের একটা স্পেশাল বৈশিষ্ট্য আছে, তিনি প্রায় সব এক্সামেই ছোট-বড় পুরস্কার রাখেন। সে পুরস্কার হতে পারে একটি কলম, একটি শ্যাম্পু, হুইল সাবান, কিংবা কম্বল, মশারী, এমনকী প্রেসার কুকার। আমি তখন গিয়েছি এক বছরে তিন ইয়ার ফিজিক্স টেনে তোলার অদম্য মনশক্তি নিয়ে- প্লাস পুরস্কারের নেশা: খুব দ্রুতই পড়া বুঝে একের পর এক প্রাইজ নিতে শুরু করলাম। আমরা তখন তিন রকম এক্সাম দিতাম- দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক। প্রাইজ যত পেতাম, তত বেশি নেশা বাড়তো। মোটামুটি আমি নিজের মার্ক আর প্রাইজের মধ্যে কাউকে ঢুকতে দিতাম না। ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে মাংস ফেললে সে যেমন হামলে পড়ে, আমি প্রশ্ন দেখলে লিটারালি ঐভাবেই হামলে পড়তাম।

জব এইডে (ভাইয়ের কোচিং) স্টুডেন্টের আধিক্য থাকত অনেক। সিট ম্যানেজ করতে সমস্যা হত প্রায়দিনই। আমি বেঞ্চে, টেবিলে, এমনকী রাস্তায় বসেও এক্সাম দিয়েছি। সেটা দিয়েও অধিকাংশ দিনই ফার্স্ট হতাম; প্লেস ম্যাটার ছিল না, আমাকে মাঝদরিয়ায় ফেলে এক্সাম নিলেও সেম আউটপুটই আসতো- এটার সিওরিটি দিতে পারি।

প্রিপারেশনের মাঝে কোভিড-১৯ এল, কোচিং বন্ধ হলো, জীবন হলো স্থবির। টিউশনিগুলোও চলে যাচ্ছিল। আল্লাহর রহমতে, আম্মুর এবং তার দোয়ায় এরমাঝে ১৩তম গ্রেডের একটি চাকরিও হয়ে গেল '২১ এর জুলাইয়ে। খুলনা শিফট করে রাকিব ভাই, সাঈদ ভাইয়ের সাথে পরিচিত হলাম, শুরু করলাম লিখিত পরীক্ষার জার্নি। নানান উত্থানপতন সঙ্গে নিয়ে অতঃপর ২য় এটেম্পটে ১ম চয়েসের ক্যাডার পেলাম।

এই জার্নির মূল বেসটা গড়ে নিয়ে গেছিলাম কুষ্টিয়া থেকেই। পরবর্তীতে জ্ঞানভাণ্ডারকে কেবল মডিফাই করেছি নানান আঙ্গিক দিয়ে, নানান উপাদান দিয়ে। প্রেজেন্টেশন বদলেছি। অনেক কিছু নিজের মধ্যেই ছিল, সেগুলোকে চ্যানেল করে কেবল বিসিএসের রাস্তায় এনেছি। 

পরিশেষে বলব, প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু যুগান্তকারী ঘটনা থাকে- যা পুরো জীবন বদলে দেয়। আমার ক্ষেত্রে সেটি হবে সেই ক্যালকুলাস-২ এক্সামের দিন, যেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে। তারপর থেকে আমি আর কোনদিন পেছন ঘুরে তাকাইনি। বিগত এক্সামের ক্যাডারদের সাথে, ভালো ভালো ভার্সিটির পড়ুয়াদের সাথে, লাইব্রেরিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পড়ুয়াদের  পরীক্ষা দিতে হবে- এইসব কথা আমার মনোবল কোনদিন বিন্দুমাত্র ডাউন করতে পারেনি। কারণ আমি জানতাম, আমাকে বিগত ৪ বছরের গ্লানি মুছতে এবং আগামী ৩০ বছরের ক্যারিয়ারের জন্য লড়ে যেতে হবে। সেটা যদি আগামী ৫ বিসিএসও লাগতো, আমি চুপচাপ পড়ে যেতাম- সব গ্লানি-কষ্ট বুকে নিয়ে। 

রি-এডমিশনের পর ৪ বছরে কোন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে যাইনি "সেই গ্রাউন্ডে যেদিন যাবো, যোগ্য হয়েই যাবো" - এই জেদ নিয়ে। বন্ধুবান্ধবের সাথে, প্রেয়সীর সাথে দিনের পর দিন যোগাযোগ এড়িয়ে পড়াশোনা নিয়ে থেকেছি। আমি জানতাম বিসিএস বাদে আমার ফেরার কোন রাস্তা নেই; তাই আঁকড়ে ধরেছিলাম সবকিছু দিয়ে। আমার কল্পনায়ও আমার চাওয়া আর পছন্দের ক্যাডারের মধ্যে আর কেউ কখনোই ছিল না; কেবল আমি ছিলাম, আর আমার পরিশ্রম ছিল। অন্য কিছুতেই আর মনোযোগ দেইনি তখন।

যেটা অন্যরা পেরেছে, সেটা আমরাও প্রত্যেকে চাইলেই পারি। প্রবল ইচ্ছাশক্তির পাশাপাশি মেধা, পরিশ্রম আর ভাগ্য সহায় থাকলে যেকোন পরিবেশ, পরিস্থিতি থেকে একজন বিসিএস ক্যাডার হতে পারেন। কিন্তু কথা হলো, বিসিএসকে পাওয়ার জন্য যতটুকু খাটতে হবে, যা যা সইতে হবে, আর যতটা অপেক্ষা করতে হবে- তা করতে পারবেন কয়জন? এই প্রশ্নের উত্তরেই ক্যাডার হওয়ার জন্য কী কী করতে হবে, লুকিয়ে আছে।

মায়ের কৃতিত্ব :

মা পড়াশোনা বিষয়ে জীবনে দুইদিন কেঁদেছিলেন। একবার '১৩ সালে- যেইবার অল্পের জন্য ইন্টারে প্লাস মিস করলাম, আরেকবার '২৩ সালে- যেবার তাকে জানালাম যে পুলিশ ক্যাডার হয়েছি। তিনি আরও বলেন, দু'টা মোমেন্টই  জীবনের অন্যতম স্মরণীয়; স্মৃতিতে চিরঅম্লান হয়ে রয়েছেন।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024