|
Date: 2024-02-03 07:47:43 |
একটি সপ্ন পূরনের গল্প।
ডাঃ আল ফুয়াদ ইমন
এখন আমি যে জায়গাটিতে বসে আছি এটা মগবাজার চার চাস্তার মোড়ে টংগের একটি চায়ের দোকানে। গত ৬ মাসে এই দোকানটিতেই বেশিরভাগ সময় সকালের নাস্তা করেছি।আজও তাই করতেছি। কথা গুলো যখন লিখছি তখন সময় ৮.৯ মিনিট ।
আমার স্ত্রী গতবছর ঢাকাতে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে যোগদান করে।সেই সুবাদে পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমরা দুইজন ঢাকাতেই শিফট করবো।হাসপাতালের কাছেই ছোট্ট একটা সাবলেট বাসাতে উঠলাম।আমাদের টোনা টুনির নতুন সংসার। দুজন ঘুরেফিরে সংসারের টুকিটাকি জিনিস কেনা,কাঁচাবাজার করা,ঘর গোছানো, এভাবেই হেসেখেলেদিন কাটতে লাগলো।এ যেনো এক অন্য রকম অনুভূতি, ব্যাচেলর জীবনে কখনো ভাবিনি যে আমি মা বাবাকে ছেড়ে একা সংসার করবো।জয়েন পরিবার+ পরিবেশে বেড়ে উঠা দুইজন মানুষের পক্ষে একা থাকা মোটেও সহজ ছিল না।রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া, ডিউটি সব কিছু মেনটেইন করা অনেক কঠিন মনে হচ্ছলো প্রথম প্রথম। অতপর আমি আমার চাকরি জন্য নতুন সিভি বানিয়ে শহরের এই প্রন্ত থেকে ওই প্রান্তে ভাইভা দিতে লাগলাম। একটা চাকরি কনফার্ম হলো, কিন্তু সেটা অনেক দূর। সুরাইয়া আমাকে এত দূরে ডিউটি করতে নিশেধ করলো, ধৈর্য ধরতে বলল।সে ছিল আমার মানসিক শান্তি।🌼।মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ্য থেকে আমার জন্য এক বিশেষ নেয়ামতসরূপ।
মহান আল্লাহ তায়া’লার অশেষ মেহেরবানিতে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই একটা চাকরি পেয়ে গেলাম।সম্পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে ডিউটি করতে শুরু করেদিলাম।সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। বাসের জন্য অপেক্ষা করা। বাসের মধ্যে এমন গাদাগাদি করে উঠা। সে যেনো এক প্রতিযোগিতা, কে কার আগে বাসে উঠতে পারে। এই প্রতিযোগিতা যেনো নিজের চাকরি ধরে রাখার লড়াই। কারণ আপনি বাসে উঠতে না পারলে ডিউটিতে পৌঁছাতে লেট করবেন। অফিসে আপনার পজিশন নস্ট হতে থাকবে দিনের পর দিন। তাই এইভাবেই ধাক্কাধাক্কি করে আমারও দিন চলতে লাগলো। রিক্সাতে ৮০ টাকা /১০০ টাকা ভাড়া লাগতো অফিসে যেতে।যেটা অনেক ব্যয়বহুল মনে হত আমার কাছে। আমি রিক্সায় না চড়ে টাকাটা সেভ করতাম।আর যেদিন বাস পেতাম না সেই দিন আমি ৪ কিলো পুরো রাস্তা হেঁটে হেঁটে অফিসে চলে আসতাম।যদি ঘেমে যেতাম তাহলে একসেট ড্রেস অফিসেই রাখতাম, চট করে সেটা পরে নিতাম। আবার বাড়ি ফেরার পথে আবার সেই ধাক্কা ধাক্কির লড়াই, এবার আরো কঠিন অবস্থা। সন্ধ্যার পর পকেটমারের উৎপাত। এই পকেটমারদের হাত থেকে নিজের মোবাইল + মানিব্যাগ হেফাজত করা যেনো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।
বাসায় ফেরার পথেও বেশির ভাগ দিন বাসে এত মানুষ থাকতো যে আমি উঠতেই পারতাম। তখন আল্লাহর নাম নিয়ে হাঁটা শুরু করতাম। আল্লাহর নামের জিকির করতে করতে ৪০ মিনিটেই বাসায় পৌঁছে যেতাম।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই সুরাইয়াকে নিয়ে কলোনির মধ্যেই হাঁটতে বের হতাম।বাদাম,ফুসকা,বুট কালাই, ঝালমুড়ি ওর খাবারের মেনু ছিল,আমরা দুজন সারাদিন কি কি করলাম,কার ডিউটি কেমন কাটলো সেইসব গল্প করতাম,মাঝে মাঝে পুরান ঢাকাতে রাতের খাবার খেতে চলে যেতাম ওকে নিয়ে। সাধ্যমত চেস্টা করেছি ডিউটির মাঝেও পরিবারকে সময় দিতে।।আমার এই দিনগুলিতে কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়াই আমার জীবনের সুখ দু:খ,,সমস্যা,সমাধানের গল্পগুলো শুনে গেছে আমার বন্ধু Arman Oli। অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝেই আরমানের সাথে আড্ডা দিতাম। ওর সাথে দেখা না হলেই মনে হতো দিনটা অপূর্ণ থেকে গেছে।
ডিউটিতে জয়েন দেবার পর বাড়ি যেতে পারিন। আব্বু আম্মু আমাদের দেখতে এসেছিল। প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা হতো, সেটাই ছিল একমাত্র সান্ত্বনা। নিয়ামতপুর বরেন্দ্র গাড়িতে আম্মা খাবার রান্না করে পাঠাতো আমাদের দুজনের জন্য।বাসায় ফিরে রোজ ভিডিও কলে বন্ধুদের সাথে গ্রুপে আড্ডা দিতাম। সারাদিনের ক্লান্তি ওদের সাথে চিল্লাচিল্লি করেই যেনো কোথায় হারিয়ে যেতো।আমার কাজিনরা, আমার বন্ধুরা আমার মানসিক শক্তি যোগাতো।তারা আমাকে কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা দিতো। এভাবেই আমাদের স্ট্রাগলের দিন চলতেছিলো।
এরপর একটা বাইকের প্রয়োজন অনুভব করলাম। সুরাইয়ার সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করলাম।সে খুব খুশি, তার ইচ্ছা আমার যাওয়া আসার কস্ট কম হবে, আর তাকে নিয়েও মাঝে মাঝে ঘুরতে পারবো,তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারবো। আমি এর মধ্যে Md Zahangir Kabir
আংকেলের পরামর্শে ড্রাইভিং লাইসেন্স টা করে ফেলি।এরপর আব্বুকে ফোন করলাম, বাইক কেনার অনুমতি চেয়ে।প্রথমের দিকে আব্বু রাজি হচ্ছিলেন না, কারণ এই ব্যস্ত শহরে বাইক চালানো অনেক রিক্স। অনেক রিকুয়েষ্ট করে, আম্মাকে দিয়ে আব্বুর পা হাত ধরে রাজি করালাম।বাবার অমতে কোন কিছু করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারিনা। আমার বাবা হলেন আমার সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা। ইচ্ছে ছিল আব্বু আম্মু সহ সবাইকে নিয়ে বাইক কিনতে যাব। কিন্তু সকলেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে একা একাই কিনতে হলো। সবাইকে খুব মিস করেছি।
আগে বাবার টাকায় জাহাজ কিনার সপ্ন দেখতাম। এখন নিজের টাকায় জুতা কিনতে ইচ্ছে করেনা। কারণ বাস্তবতা অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।পরিবারের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব থাকে যেটা এড়িয়ে যাবার কুশিক্ষা আমরা পরিবার থেকে পাইনি। আলহামদুলিল্লাহ।
বাইক কেনার জন্য বাসায় কখনো বায়না ধরিনি। কারণ আমি দেখেছি অনেক পরিচিত মানুষ লড়াই করে কস্ট করে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারাই আমার বড় অনুপ্রেরণা। সব সময় ভেবেছি তারা পারলে আমি কেনো পারবোনা। আমিও পারবো ইনশাআল্লাহ। বাবাকে আর বিন্দু মাত্র প্রেশার দিতে চাইনা,ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে এইটুকুই বলবো। পরিশ্রমের বাহিরে কোন কথা নাই,কোন সাফল্য নাই। হালাল পথে উপার্জিত অর্থে চলার মত সুখ, শান্তি, বরকত কোন কিছুতেই নাই।পারিবারিক শান্তিটাই মানুষের জন্য আসল। পরিবারের মানুষ যদি আপনাকে বুঝে তাহলে আপনার জীবন অনেক সহজ ভাবে চলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আর নিজের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে তাদেরকে ভুলে যাওয়া যাবেনা যারা আমাকে তাদের মূল্যবান সময় দিয়ে সব সময় পাশে থাকেছে,মোটিভেট করেছে,সাপোর্ট দিয়েছে,আমি সকলের প্রতি চির কৃতজ্ঞ।
মামার টঙ এ নাস্তা করলাম, দোকানদার মামাকে মিস্টি মুখ করালাম । মামাও খুব খুশি যে আমি তাকে বাইক টা দেখাতে নিয়ে এসেছি, ঘুরে ঘুরে বাইকটা দেখতেছে.............
আমি বসে বসে লিখছিলাম,হটাৎ সামনে দিয়ে একটা বাস চলে গেলো,কিছু মানুষ বাসে ঝুলতেছে।এইভাবে আমিও গতকাল ঝুলতে ঝুলতে ডিউটি করেছি।আজ মহান আল্লাহ তায়া’লার অশেষ মেহেরবানি সেই স্ট্রাগল টা নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ
আহ!!!!!!! জীবন 🫶💐
মহান আল্লাহ তায়া’লা সকলের মনের সৎ ইচ্ছা পূর্ণতা দান করুন, আমার পরিবারের জন্য সকলে দোয়া করবেন আমিন।
© Deshchitro 2024