উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে: নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর সাথে সে দেশের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকাম আর্মির সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের রেশ এসে পড়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মাঝে। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা আরাকান আর্মিকে সমর্থন করলেও কেউ কেউ বিশ্বাস করতে পারছে কাউকেই। আবার কেউ কেউ এবিষয়ে করছেন না কোন মন্তব্য।


বৃহস্পতিবার (০৮ ফেব্রুয়ারী) এই প্রতিবেদকের কথা হয় রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে। রোহিঙ্গা নেতা ছাড়াও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথেও কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।



এদিকে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি প্রধান নবি হোসাইন মিয়ানমারের ঢেকুবনিয়া ক্যাম্প দখলের দাবি করে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। ৫ ফেব্রুয়ারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় এমন দাবি করে গ্রুপটি।


এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ কমিটির বোর্ড মেম্বার রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন কোন পক্ষের প্রতি অবস্থান স্পষ্ট না করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের মানুষ সবাই বলছে আমাদের বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে। আমরাও চলে যেতে প্রস্তুত আছি, রাজি আছি। কিন্তু আমাদের অবস্থান হচ্ছে সেফটি, সিকিউরিটি, ডিগনিটি (নিরাপত্তা এবং আত্মমর্যাদা) এই তিনটা বিষয় নিয়ে প্রত্যাবাসন হোক সেটা আমরা চাই। বাংলাদেশও এই তিনটা বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন করতে চায়। আমরা এটাতে রাজি আছি। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে যেতে রাজি থাকলেও সেফটি, সিকিউরিটি, ডিগনিটি প্রত্যাবাসন যেটাকে বলছি সেটা যদি হয় তাহলেই আমরা রাজি আছি নিজ দেশে ফেরত যেতে নাহয় আমরা যেতে রাজি নয়।


আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির ভিডিও বার্তা নিয়ে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আমরা আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির আহ্বান ভিডিওতে দেখেছি কিন্তু আমরা হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমরা বাংলাদেশ সরকারের উপর ভরসা করে থাকা মানুষ। আমরা অশিক্ষিত মানুষ। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করছি সেফটি সিকিউরিটি ডিগনিটি নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। আমরা ওটাতেই রাজি আছি। বাকি এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশ সরকার তাদের সাথে বুঝাপড়া করলেই ভালো হবে বলে আমার মনে হয়।



আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সাথে বসে আমাদের এই রোহিঙ্গা ক্রাইসিস টা সমাধান করার জন্য। এমন আহ্বান জানান এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ কমিটির বোর্ড মেম্বার রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন।


তবে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এ্যন্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইস) এর চেয়ারম্যান হওয়া মোহাম্মদ জুবায়েরের দাবি, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন আমাদের পূর্ণ অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাচ্ছে এজন্য আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার জান্তা সরকার মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে বলে একটা নাটক দেখাচ্ছে”।


এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আরাকান আর্মির প্রধান বিবিসির সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা জাতি বলে স্বীকার করেনি তারা নাকি আমাদের বাঙালি হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু আমরাতো রোহিঙ্গা জাতি, আমরাতো বাঙালি নয়। আমাদের পূর্ণ অধিকার, মর্যাদা এবং সম্মান দিয়ে প্রত্যাবাসন হলেই আমরা রাজি আছি ফেরত যেতে। আমরা এই মুহূর্তে কোন পক্ষকে বিশ্বাস করতে পারছি না।



সাধারণ রোহিঙ্গারা এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে আরাকান আর্মির পক্ষে তাদের একটা সহানুভূতি কাজ করছে। সম্প্রতি একটা রোহিঙ্গা সমাবেশ থেকেও প্রকাশ্যে আরাকান আর্মিকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। দাঁড়িয়ে জানানো হয়েছে সম্মানও।

উখিয়ারবা লুখালী ক্যাম্পের মোহাম্মদ নুর (১৯) বলেন, আমারা মগদের (জান্তা বাহিনী) সমর্থন কিভাবে করব। আমাদের যেভাবে নিপিড়ন চালিয়েছে তারা। আমাদের এখন খুব ভালো লাগছে। শান্তি লাগছে তাদের উপর এই অবস্থা দেখে। আমরা আরাকান আর্মির জন্য দোয়া চাচ্ছি। আরাকান আর্মি সফল হোক।


আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ জামাল বলেন, আমাদের আরাকান আর্মিকে ভালো লাগছে। তবে তারাও যদি জান্তা বাহিনীর মতো করে। এখনো তো বিশ্বাস করতে পারছি না। তারপরও আরাকান আর্মিকে সমর্থন করছি।


শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. রাহমান নাসির উদ্দীন বলেন, মিয়ানমারে এখন যেটা সামরিক যুদ্ধ চলছে সেটা সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। একইসাথে যদি সেখানে নতুন কোন গণতান্ত্রিক সরকার আসে তাহলে রাতারাতি রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে এরকম কোন সম্ভাবনা আমি দেখি না। আরাকান সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের আরাকানের বা রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। যদিও আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে আরাকান আর্মি এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভমেন্ট রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে সনাক্ত করছে, রোহিঙ্গা বলে ডাকছে, রোহিঙ্গা শব্দ টা ব্যবহার করছে। তারপরও যদি সামরিক জান্তার পতন হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার আসে তাহলে প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা রাতারাতি মিয়ানমারে চলে যাবে সেটা আমি মনে করিনা।



রাহমান নাসির মনে করেন, ভবিষ্যৎ আরো কঠিন হতে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। যদি আরাকান আর্মির হাতে রাখাইন রাজ্যের দখল অব্যাহত থাকে, তবে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমি ফেরত পাবে কিনা তাতেও রয়েছে সন্দেহ।


২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাঁচতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। পরে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও সেটি বাস্তবায়নের পথে এগোয়নি।


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024