ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ও ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ নামের দুটি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। কক্সবাজারের স্থানীয় এবং ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা মনে করেছিলেন এ দুটি ট্রেন তাদের কক্সবাজার যাত্রাকে আরও আনন্দময় করে তুলবে। কিন্তু এই দুটি ট্রেনের টিকিটও প্রতিদিন উধাও হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে।


টিকিট উন্মুক্তের পর যাত্রীরা সার্ভারে প্রবেশ করার আগেই সিন্ডিকেট চক্র টিকিট নিজেদের কব্জায় নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই রুটের টিকিটের জন্য হাহাকার চলছে। কয়েকগুণ বেশি টাকা দিলে দালালদের কাছে চাহিদামতো টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।


এ রুটে শুরু থেকেই টিকিট নিয়ে কালোবাজারি চক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে স্বস্তির ট্রেন ভ্রমণ বিষাদে পরিণত হয়েছে। রেলের টিকিট পাওয়া এখন অনেকটা সৌভাগ্যের বিষয়। নানা সমালোচনা, নানা উদ্যোগ নিয়েও অনেক বছর থেকে টিকিট নিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি কিছুতেই লাঘব করা যাচ্ছে না।


দালাল, সিন্ডিকেটের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পায়নি টিকিট। অনলাইনে টিকিট উন্মুক্ত করার পর মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায় টিকিট। মজুত করে নিজেদের সংরক্ষণে রাখে সিন্ডিকেট চক্র। উধাও হয়ে যাওয়া ন্যায্যমূল্যের এসব টিকিট দালালদের কাছ থেকে যাত্রীদের কিনতে হয় দ্বিগুণ, তিনগুণ বেশি টাকা দিয়ে।


সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সারা দেশের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারীদের যোগসাজশে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের সহযোগিতায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা অনলাইন ও কাউন্টার থেকে বিভিন্ন কৌশলে টিকিট সংগ্রহ করে।


অনেক সময় অনলাইন টিকিটের ম্যানেজমেন্টর দায়িত্বে থাকা সহজ ডটকমের অসাধু কর্মকর্তারাও কালোবাজারিদের সহযোগিতা করেন।


আর কাউন্টার থেকে চক্রের সদস্যরা নিজে, তাদের স্বজন, হকার, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, কুলি, ভিক্ষুকসহ বিভিন্ন ধরনের লোকদের দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করায়। প্রতিজনের নামে ৪টি করে টিকিট বিক্রি হয়।




যাদের দিয়ে এসব টিকিট সংগ্রহ করানো হয় তাদের ১০০ টাকা করে দেয়া হয়। ন্যায্যমূল্যে এসব টিকিট কেটে পরে যাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।


অনেক সময় কাউন্টারে টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের অজান্তে তাদেরই জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেও টিকিট কেটে রাখা হয়।


একেকটি চক্রে একাধিক সদস্য থাকে। তাদের কেউ কেউ টিকিট কাউন্টার ও অনলাইন থেকে টিকিট সংগ্রহের কাজ করে। এজন্য নামে, বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র।


চক্রের কিছু কিছু সদস্য তাদের সংরক্ষণে থাকা টিকিট বিক্রির জন্য যাত্রী সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে একেক সদস্যের একেক রুটের যাত্রী সংগ্রহের দায়িত্ব থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া টিকিট কালোবাজারিদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে রেলওয়ে পুলিশ ও পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব বেশ কিছু টিকিট কালোবাজারিকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।


র‌্যাব ঢাকা কেন্দ্রিক বড় একটি সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। একইভাবে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় স্টেশনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের অন্যতম সদস্য রেলওয়ের বুকিং সহকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। রেলওয়ে পুলিশ


সূত্র জানিয়েছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর এলাকা থেকে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে ক্যান্টনমেন্টন রেলওয়ে স্টেশনের নারী বুকিং সহকারী সাথী আক্তার (৩৩)কে গ্রেপ্তার করে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ।


তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাথী প্রতিদিন স্টেশনে ডিউটিতে আসার পরে নিজের বুকিং আইডি দিয়ে বিভিন্ন তারিখের, বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনের টিকিট কেটে নিজের কাছে রেখে দিতেন। এরপর ডিউটি শেষে কেটে রাখা টিকিটগুলো কৌশলে লুকিয়ে স্টেশন ত্যাগ করতেন। পরে টিকিটগুলো তার চক্রের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে লভ্যাংশের টাকা বুঝে নিতেন।


১২ই ফেব্রুয়ারি ভৈরব রেলওয়ে পুলিশ বিভিন্ন গন্তব্য ও তারিখের ১৬টি আসনের টিকিটসহ মো. মমিন (৩৪) নামের এক টিকিট কালোবাজারিকে গ্রেপ্তার করে। ৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন এলাকা থেকে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী মো. নুর আলম মিয়া (৩০)কে গ্রেপ্তার করে।


৪ঠা ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ রেলওয়ে পুলিশের একটি দল ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী ও টিকিট কালোবাজারির অন্যতম হোতা মো. রফিকুল ইসলাম (৩০)কে প্ল্যাটফর্ম থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার প্যান্টের ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকানো বিভিন্ন তারিখের বিভিন্ন গন্তব্যের ১২টি টিকিট সাধারণ যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর সম্বলিত একটি তালিকা উদ্ধার করা হয়।


এ ছাড়া নগদ ৫ হাজার ১০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ১৫ই ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে থানা কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে বিশেষ অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত টিকিট কালোবাজারি সাইফুল ইসলাম (৪৫)কে ভিন্ন ভিন্ন ট্রেনের ২৪টি আসনের ১২টি টিকিটসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তার নিকট থেকে কালোবাজারি টিকিট বিক্রির নগদ ৭ হাজার ৬৭০ টাকা ও ১টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।


রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, কালোবাজারিদের রাজত্ব শেষ করতে তাদের নিয়মিত অভিযান চলবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বিশেষকরে বিভিন্ন স্টেশনের বেশ কিছু বুকিং সহকারীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।


এদিকে চলতি মাসের শুরুর দিকে র‌্যাব-৩ এর আভিযানিক দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা সেলিম, আনোয়ার হোসেন, অবনী সরকার সুমন, হারুন মিয়া, মান্নান, আনোয়ার হোসেন, ফারুক, শহীদুল ইসলাম বাবু, মো. জুয়েল, আব্দুর রহিম, উত্তম চন্দ্র দাস, মোর্শিদ মিয়া, আব্দুল আলী, জোবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ২৪৪টি আসনের টিকিট।


র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কমলাপুর রেলস্টেশনে সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত সেলিম এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত উত্তমের নেতৃত্বে চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে মহানগর প্রভাতী, তূর্ণা নিশিথা, চট্টলা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে আসছিল।


র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, চক্রের সদস্যরা উপযুক্ত সময় বুঝে সংগ্রহকৃত টিকিট নিয়ে রেলস্টেশনের ভেতরে অবস্থান করে। রেলস্টেশনে এসে টিকিট না পাওয়া সাধারণ যাত্রীদের নিকট গ্রেপ্তারকৃতরা টিকিট বিক্রির জন্য ঘুরাঘুরি করে এবং অধিক মূল্যে টিকিট বিক্রি করে থাকে।


তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সেলিম দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর ধরে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। সে কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় টিকিট কালোবাজারির দায়ে ৭টি মামলা রয়েছে। আনোয়ার হোসেন ওরফে কাশেম প্রায় ১৫ বছর ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। সে গ্রেপ্তারকৃত সেলিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী। মূলত তার দায়িত্ব ছিল কাউন্টার থেকে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করা।




গ্রেপ্তারকৃত অবনী সরকার ও হারুন মিয়ার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম এলাকার কাস্টমার সংগ্রহ করা। মান্নান এবং আনোয়ার ওরফে ডাবলুর সিলেট এলাকার, ফারুক এবং শহীদুল ইসলাম বাবুর ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের, জুয়েল এবং আব্দুর রহিমের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া, আব্দুল আলীর ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ, মো. জুবায়েরের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের যাত্রী সংগ্রহ করা।


গ্রেপ্তারকৃত প্রায় সবার বিরুদ্ধেই টিকিট কালোবাজারির মামলা রয়েছে এবং তারা জেল খেটেছে। উত্তম প্রায় ১৫ বছর ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। সে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের টিকিট কালোবাজারি চক্র উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। মোর্শেদ মিয়া প্রায় ৫ বছর ধরে গ্রেপ্তারকৃত উত্তমের প্রধান সহযোগী হিসেবে টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। তার মূল দায়িত্ব ছিল অনলাইনে টিকিটপ্রত্যাশীদের সঙ্গে টিকিটের দর কষাকষি করে দাম নির্ধারণ করা।


ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, বুকিং সহকারীরা কাউন্টারে টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে রাখে। পরে তারা এসব আইডি ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে টিকিট কাটে। এসব অভিযোগে কয়েকজন বুকিং সহকারীকে আমরা হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছি। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।


যাকেই এ ধরনের কাজে যুক্ত পাবো তাকেই গ্রেপ্তার করবো। আরও কয়েকজনের তথ্য পেয়েছি সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছি। তবে রেলওয়েকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ তাদের বুকিং সহকারীরা যাতে এ ধরনের কাজ করতে না পারে।


এ ছাড়া সাধারণ যাত্রীদেরও বলবো তাদের কাছ থেকে যদি কেউ টিকিট কিনতে চাইলে বেশি টাকার প্রস্তাব দেয় তবে তারা যেন রাজি না হয়ে আমাদের জানায়। তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারবো। তিনি বলেন, যাত্রীরা আসলে আমাদের সহযোগিতা করেন না। বরং তারা ন্যায্যমূল্যের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে কিনছে।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024