শিশুর দেহমনকে পুষ্ট করে তোলার জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। তেমনিভাবে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা অপরিহার্য। একমাত্র মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই আমাদের প্রাণশক্তি জীবন্ত হয়ে উঠে।


মহানবী (সঃ) এর শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন “আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, তাদের কাছে পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য” (সুরা ইব্রাহীম)। আমাদের প্রিয়নবী (সঃ) এর মাতৃভাষা আরবী বিধায় পবিত্র কুরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে।


পবিত্র কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার অর্থই হচ্ছে মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রিয় নবী (সঃ) এর মাতৃভাষাকে সম্মানিত করা। যদি আরবী ভাষা একান্তই আল্লাহর ভাষা হতো তাহলে প্রতিটি আসমানী কিতাব আরবী ভাষায় নাযিল হতো আর প্রত্যেক নবীই আরবী ভাষাভাষী হতেন। কিন্তু একমাত্র পবিত্র কুরআন ছাড়া ১০৪ থানা আসমানী কিতাবের মধ্যে অন্য একটি আসমানী কিতাবও যেমন


আরবী ভাষায় নাযিল হয়নি তেমনি ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বরের মধ্যে একমাত্র আমাদের প্রিয়নবী (সঃ) ছাড়া অন্যকোনো নবীর মাতৃভাষাও আরবী ছিল না।


মহান আল্লাহ পাক প্রত্যেক নবীগনের উপর তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন।

প্রত্যেক ভাষাই আল্লাহর নিকট সমমর্যাদা সম্পন্ন। সুতরাং মাতৃভাষার গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। এই মাতৃভাষার মর্যাদা দান ও চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয়নবী (সঃ) ছিলেন আদর্শের মূর্ত প্রতীক।


এই মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবিকে “প্রাদেশিকতা দুষ্ট” বলে অভিহিত করেছিলেন। যারা এমন দাবি তুলে তারা যথার্থ মুসলিম নয় এমন ইঙ্গিতও তিনি করেছিলেন।


তার সেই ইঙ্গিতে যারা গর্জে উঠেছিলেন তাদের মধ্যে জ্ঞানতাপষ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও ছিলেন। তার যুক্তি ছিল ঐতিহাসিক ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত। তখন থেকেই বাঙালি জাতির মধ্যে বিভিন্ন চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হয় এবং বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষায় রূপ দেয়ার জন্য বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।


রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় খুব শীঘ্রই তা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠে। সে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও। বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রথম সফল সংগ্রাম হিসেবে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রেই একুশের চেতনা বাঙালির জনমনে মাইলফলক হিসেবে ক্লাজ করেছে।


পরবর্তীকালে এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়।


সালাম, রফিক, বরকতসহ ভাষা শহীদানদের আত্মাহুতির ফলে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা আজ বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলা শিল্পসংস্কৃতি, গান, নাটক, কবিতা, ছড়া, সিনেমা ও চিত্র-কর্ম ইত্যাদি হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য সমূহ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছে। আজ যে আমরা মাতৃভাষায় আমাদের মনের ভাব ফুটিয়ে তুলছি তা ভাষা শহীদদের ত্যাগের ফল। অনেক দেশে বাংলা ভাষা দ্বিতীয় তাত্ত্বিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এর স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের আত্যাগকে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের কাছে মাইল ফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।


বিশ্বের প্রায় ২৫ (পঁচিশ) কোটি মানুষ বাংলা ভাষাভাষি। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে ৮ম স্থানে অধিষ্ঠিত করা ও ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেনের নাম অবিস্মরণীয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় গীতাঞ্জলী কাব্য গ্রন্থ রচনা করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।


স্বাধীনতার পর কক্সবাজারে প্রথম শহীদ দিবস উদ্‌যাপনের জন্য এখানে কোন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছিল না। কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ দিবস পালনের জন্য কারও মাথা ব্যাথাও ছিল না।


এমতাবস্থায় কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে

একটি শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য কয়েকজন শিক্ষক (মাস্টার বদরুল আলম, আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ আহমদ, সুগত বড়ুয়া, দীননাথ রায়) এবং কিছু ছাত্র মুজিবুর রহমান, আব্দুল কাদের, মোঃ আলী, আলতাফ হোসেন, কবির আহমদ, খোরশেদ আলম, সমীর পাল এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে ১৯৭২সালে ১০ জানুয়ারী আমরা শহীদ মিনারের জন্য জায়গা এবং অনুমতি দেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল কাদের সাহেবকে অনুরোধ করি।


প্রথমে সরকারের অনুমতি ছাড়া তিনি অনুমতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কাদের স্যারকে রাজি করানোর জন্য আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী, একে এম মোজাম্মেল হক, ছাত্রলীগ নেতা দিদারুল আলম, মোঃ গফুর এবং হাবিবুর রহমানকে অনুরোধ করি। তাদের অনুরোধ এবং আমাদের পীড়াপিড়িতে কাদের স্যার অবশেষে রাজী হলেন।


১৮ জানুয়ারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের স্যারের সভাপতিত্বে শিক্ষা পরিষদ এবং ছাত্রদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান শিক্ষককে প্রধান পৃষ্টপোষক এবং আমাকে আহ্বায়ক করে নকশা প্রণয়ন জায়গা নির্বাচন, শহীদ মিনার নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করে। সভায় ১২ সদস্যের একটি শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন মাস্টার আব্দুর রাজ্জাক, মোঃ বদরুল আলম, মোঃ সৈয়দ আহমদ এবং মাস্টার সুগত বড়ুয়া ও দ্বীননাথ রাম।


ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মোঃ আলী, আলতাফ হোসেন, মজিবুর রহমান, আব্দুল কাদের, কবির আহমদ, সমীর পাল ও খোরশেদ আলম। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, ১০ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে নির্মাণ কাজ চূড়ান্ত করতে হবে।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সামাদ (মরফিয়া সামাদ) কে দিয়ে শহীদ মিনারের একটি এবং স্মৃতি ফলকের দুটি নকশা তৈরি করি। স্মৃতিফলক দুটি হলো- একটি স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অপরটি অত্র বিদ্যালয়ের নিহত ছাত্রদের জন্য।


উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে কক্সবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষক যথাক্রমে জনাব শাহ আলম ও বশির আহমদ ঢাকায় প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা যায়। আর একজন শিক্ষক বাবু প্রিয়দর্শী বড়ুয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বার্মায় মংডু ক্যাম্পে মারা যায়।


ছাত্রদের মধ্যে স্বপন ভট্টাচার্য, সুভাষ দাশ, শিশির বড়ুয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার দস্যুদের কাছে শহীদ হন। আমরা বোনার পাড়ার নবী হোসেন মিস্ত্রীকে দিয়ে কাদের স্যারের দ্বারা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে স্কুলের পশ্চিম গেইটের পাশে জানুয়ারীর ৩১ তারিখ শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করি।


ছাত্র শিক্ষক সবার কাছ হতে চাঁদা তুলে স্টেডিয়াম কমিটি থেকে কিছু পরিত্যক্ত ইট সংগ্রহ করে ১৫ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করি।


আওয়ামী লীগ নেতা একেএম মোজাম্মেল হক, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল হোসেন চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা দিদারুল আলম, আব্দুল গফুর, প্রাক্তন এমএলএ নূর আহমদ ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান আমাকে এই কাজে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন।


১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজারের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন, স্কুল কলেজ, রক্ষী বাহিনী, পুলিশ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। এবং পরবর্তীতে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে পরিগণিত ছিল। শহীদ মিনার নির্মাণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে পেরে নিজেদেরকে গর্বিত মনে করি। কারণ এ ভাষা আন্দোলনই পরবর্তীতে প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে দেশ স্বাধীন হয়।


পরিশেষে বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই স্বশ্রদ্ধ সালাম ও বিনম্র ভালবাসা। মহান ভাষা শহীদদের এই মাসে তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।


লেখক : প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, কক্সবাজার সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বর্তমান মহাপরিচালক, বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, কক্সবাজার।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024