|
Date: 2024-02-21 10:21:50 |
২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ‘শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস’ শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মো: হেলাল উদ্দিন সহ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে দুই অঞ্চলের মধ্যে অসম অর্থনীতি ছাড়াও জাতিগত, প্রকৃতিগত, সংস্কৃতিগত এবং ইতিহাসের স্বতন্ত্র সত্তাগুলি ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলা ও প্রবঞ্চনা শুরু হয়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল উপনিবেশিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক এবং অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও নির্যাতনের এক করুন ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সংঘাতের সূচনা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে জিন্নাহ একুশে মার্চের জনসভায় এবং ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের উপর উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নীতি অনুসরণ শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভাষার উপর আঘাত হানে এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়। জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' বলে ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। যেখানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ লোক বাংলা এবং ৭.২% লোক উর্দু ভাষায় কথা বলে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বস্তুত জিন্নাহ এই সময়ে বাঙালি বিদ্বেষী পাকিস্তানি আমলাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। সুতরাং জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের নিকট থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কারণ বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। জিন্নাহর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় এর ব্যাপক আন্দোলন দেখা যায়। আন্দোলনের প্রথম স্তরেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সনের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ মৃত্যু হলে তাঁর স্থলে গভর্নর জেনারেল পদে অভিষিক্ত হন উর্দুভাষী বাঙালি খাজা নাজিমউদ্দীন।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনরায় ঘোষণা দিলে এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ' গঠিত হয়। ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠনের দিন যুবলীগ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সম্বলিত প্রস্তাব সমর্থন করে এবং পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে আবেদিত বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে। প্রদেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট ও ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু ২১ তারিখে ঢাকার ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং প্রতিবাদ মিছিল বের করে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী ছাত্রদের উপর গুলি চালায় ফলে বহু ছাত্র জনতা আহত এবং শহীদ হয়। শহীদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত, সালাম এবং রফিকসহ অনেকে ছিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ ধর্মঘট পালিত হয়। সমগ্র প্রদেশব্যাপী মাতৃভাষার দাবিতে সর্বত্র গণবিক্ষোভ চলতে থাকে। বহু ছাত্র, শিক্ষক, জননেতা গ্রেফতার হন। সর্বত্র ধরপাকড় শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে, তারা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন পুনরায় বিবেচনা করে দেখবেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গণসচেতনার সুসংগঠিত সফল গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালে শাসক চক্রের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এ প্রসঙ্গে শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস, রাজশাহী'র প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানদের সঙ্গে একীভূত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়। ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাকিস্তান সরকার বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
© Deshchitro 2024