|
Date: 2024-03-08 10:55:45 |
কক্সবাজারের বিচার বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন কয়েক জন নারী। সরকারি চাকুরি জীবনে তারা আপন মহিমায় নিজেদের করে তুলেছেন অনন্য। মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার নাম। কর্মক্ষেত্রে একের পর এক সাফল্যগাঁথা রচনা করে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন দুর্বার গতিতে। এই নারীদের জীবনকথা জানাতেই দৈনিক কক্সবাজার এর আজকের বিশেষ আয়োজন।
# সাজ্জাতুন নেসা
সিনিয়র সহকারী জজ, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের দশম ব্যাচের অত্যন্ত তুখোড় মেধাবী কর্মকর্তা সাজ্জাতুন নেছা। কক্সবাজার জেলায় লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। কঠিন পরিস্থিতিতে মানবিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষকে আপন করে নিয়ে সমস্যা সমাধান, ধৈর্যের সাথে দাম্পত্য কলহ সমাধান করে নতুন জীবন দেওয়ার মত কঠিন কাজগুলো সহজে করেন এ কর্মকর্তা।
জীবনের শুরুটা চট্টগ্রামে কাটিয়েছেন তিনি। বাবা ছিলেন পাহাড়তলী রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলীর প্রভাবটা এ কর্মকর্তার জীবনে বহুলাংশে প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক জীবনেও প্রিয় অত্যন্ত সৎ দক্ষ এবং ন্যায় পরায়ন হিসেবে কক্সবাজারবাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবা মোঃ মুজিবুর রহমান এবং মা মেহেরুন্নেছা পণ করেছিলেন মেয়েকে বিচারক বানাবেন। অনেকটা বাবার ইচছায় উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছেন সহকারি জজ হয়ে। জন্মসূত্রে কিশোরগঞ্জের হলেও বাবার চাকুরির সুবাধে তিনি বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এলএলএম সম্পন্ন করে ২০১৮ সালের বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের কক্সবাজারের মহেশখালী আদালতে সহকারী জজ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থায় উচ্চ বেতনে চাকরি করে আসলেও পিতার স্বপ্ন পূরণে সেই চাকুরি ছেড়ে তিনি বিচারক হিসেবে যোগদান করেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে। আদর্শবান স্বামী রাকিবুল হাসান এবং শশুর শাশুড়ির সহযোগিতায় ঘরে বাইরে সমানভাবেই নিজের কর্মদক্ষতা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ব্যক্তি জীবনে দুই সন্তানের জননী তিনি। বড় মেয়ে মায়মুনা হাসান অর্চি এবং সদ্য ভূমিষ্ট (৩ মাস) আরহাম হাসান অর্ক। তিনি নিজেও পিতামাতার কনিষ্ঠ সন্তান।
কক্সবাজার জেলার মত পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে সমাজ ব্যবস্থার নানা সমস্যা, দাম্পত্য কলহ, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আলাদা হওয়ার প্রবণতা, রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়দের বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আইনগত জটিলতাসহ শত শত সমস্যার সমাধান তিনি করে যাচ্ছেন লিগ্যাল এইড অফিসে বসেই। সম্প্রতি বিচারপতি নাইমা হায়দার কক্সবাজার এসে এ কর্মকর্তার সফলতা দেখে বিমোহিত হন। এই কর্মকর্তা কক্সবাজারে এসে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সাধারণ মানুষকে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা প্রদানের এ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমকে জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছেন। একজন নারী হয়েও সমানতালে অফিস সংসার সামলাচ্ছেন দক্ষতার ও সততার সাথে।
# তাপ্তি চাকমা
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি)
কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ২৫ জন বিসিএস কর্মকর্তার মধ্যে ৮ জন নারী কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে জেষ্ঠ পদে রয়েছেন তাপ্তি চাকমা। তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ পদে কক্সবাজারে যোগদানের পর থেকেই প্রশাসনিক দক্ষতা, শিক্ষার মত কঠিন কাজকে কক্সবাজারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া কক্সবাজারকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত কঠিন কাজকে তিনি সহজ করেছেন আপন যোগ্যতায়।
জীবনের প্রারম্ভে তিনি কক্সবাজার প্রিপ্যারেটরী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশোনা শুরু করেন। পরে খাগড়াছড়ি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও খাগড়াছড়ি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানের বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন।
বাবা-মায়ের চাকরির সুবাদে পড়ালেখার শুরুটা কক্সবাজারে। বাবা ছিলেন কক্সবাজার জেলা তথ্য কর্মকর্তা এবং মা কক্সবাজার পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা । মাতা পিতা উভয়ের কর্মস্থল এই শহরে (কক্সবাজার) হওয়ায় পড়াশোনাও এইখান থেকে শুরু হয়। পিতামাতার অনুপ্রেরণাতেই মূলত বিসিএস ক্যাডারে হওয়া। ২০১৩ সালে ৩১তম প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন তিনি।
আলাপকালে জানালেন, ঢাকার টাঙ্গাইলে সহকারী কমিশনার হিসাবে যোগদান করে ৪ বছর পর ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিস এবং ঢাকা ডিসি অফিসে চলে আসেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রথমে কুমিল্লার হোমনাতে এবং পরবর্তীতে লক্ষীপুর রামগঞ্জে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কক্সবাজারে যোগদান করার পূর্বে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন।
কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে কোন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন - আমি যে পর্যায়ে আছি এখানে বৈষম্যের সুযোগটা কম। কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতাবলে এবং জেলা প্রশাসকের বলিষ্ট নেতৃত্বে সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়ে আসছি। জেলা প্রশাসক সুষমভাবে প্রত্যেকের কাজ বন্টন করে দেন। আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারি। কর্মজীবনে আমি খুবই উপভোগ করছি। এইখানে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে পারছি। ধাপে ধাপে এক একটি অধ্যায় পার করছি।
তিনি বলেন, প্রত্যেক অবস্থানে কাজের ধরণ আলাদা। এটাই আমার কাছে বেশি উপভোগ্য। তবে একটি জায়গায় কাজ করতে গিয়ে একজন সংসদ সদস্যের রোষানলে পড়েছিলাম। কারণ তিনি চেয়েছিলেন আমাকে দিয়ে আইনবহির্ভূত কাজ আদায় করতে। আমি তখন শক্ত হস্তে নিজের অবস্থানে ছিলাম। কাজ করতে গেলে হয়তো এমন পরিস্থিতি আরো আসতে পারে। তবে আমি সবসময় চেষ্টা করেছি সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে। এটি অব্যাহত থাকবে আজীবন।
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ১ ছেলে ও ১ মেয়ের মা। স্বামী বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন।
সমাজের একজন অগ্রসর নারী হিসেবে বর্তমান সমাজের নারীদের উদ্যেশ্যে তিনি বলেন- এখনকার নারীরা অনেক স্মার্ট এবং অনেক সচেতন। সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে এবং লক্ষ্যস্থির রেখে এগিয়ে গেলে সফলতা আসবে।নারী পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত হোক সেটা সবসময় প্রত্যাশা করি। সরকার নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমি চাই নারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে এবং প্রতিবেশী যেকোন নারীর প্রতি বৈষম্য দেখলে প্রতিবাদ করবে।
# রুবাইয়া আফরোজ
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে সদ্য যোগদান করা রুবাইয়াত আফরোজ বিবিএসের ৩৩ তম ব্যাচের কর্মকর্তা। নোয়াখালীর সেনপাড়ার স্বনামধন্য পরিবারের সন্তান গোলাম সরওয়ার তারঁ স্বামী।
বাবা তোফায়েল আহমেদ ছিলেন বিআরডিবির সহকারী পরিচালক। বাবার চাকুরির সুবাধে ময়মনসিংহের আলোকিত প্রতিষ্ঠান বিদ্যাময়ী আদর্শ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ২০১৪ সালে ৩৩ তম বিসিএস করে হবিগঞ্জের সহকারী কমিশনার হিসাবে প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন।
তিনি ২০১৭ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও সহকারী কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পানছড়ির সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং পদোন্নতি পেয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি শুরু হলে তাঁকে কক্সবাজার জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে পদায়ন করা হয়। চাকুরী জীবনে সুনাম ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। যার পুরস্কার তিনি পেয়ে যাচ্ছেন প্রতিটি পদক্ষেপে।
আলাপকালে জানালেন, নারীর হয়ে এতটুকু আসার পথ সহজ ছিলনা। অদৃশ্য আলো হয়ে সাহস যুগিয়েছেন স্বামী গোলাম সরওয়ারসহ পরিবারের সকলেই। অনেক ত্যাগ, প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে আজকে তিনি প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
তিনি জানান - চাকরি জীবনের শুরুতেই চার মাসের বাচ্চা নিয়ে প্রথম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সহকারি কমিশনার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেছেন, রাস্তা সব সময় নিজের করে নিতে হয়। অফিসের সমস্ত কাজ নিজেকে করতে হবে। নারী হিসেবে কেউ করুনা বা দয়া দেখিয়ে কাজ করে দেবেন না। নিজের যোগ্যতা দিয়ে মেধা মনন খাটিয়ে নিজের পথকে নিজের কাজকে আপন করে নিতে পারলেই তার ভবিষ্যৎ জীবন উজ্জ্বল হবে।অন্যথায় এডমিন ক্যাডারে নারীদের আসা উচিত নয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনে মোট ২৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন ৮জন নারী কর্মকর্তা। দ্বীপ উপজেলা -মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মীকি মারমা। এছাড়াও সহকারি কমিশনার হিসাবে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ৩৮ তম বিসিএস এর ইসমত জাহান ইতু, মুনমুন পাল, যারিন তাসনিম তাসিন, শারমিন সুলতানা, সৈয়দজাদী মাহবুবা মঞ্জুর।
© Deshchitro 2024