সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস যেন দুর্নীতির দোকান! শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোন বিষয় উঠলেই পাওয়া যাচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগ। স্লিপ ফান্ডে দুর্নীতি, বই বিক্রিতে দুর্নীতি, খাতা বিক্রিতে দুর্নীতি, ক্লাস্টারে দুর্নীতি, তথ্য সরবরাহে দুর্নীতি, বদলিতে দুর্নীতি। দুর্নীতি এ অফিসের গা-সওয়া বিষয়। ঘুষ-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এছাড়া গাছ বিক্রি, প্রাচির নির্মাণ, বিদ্যালয় সংস্কারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিষফোঁড়া এ অফিসকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।


সাতক্ষীরার প্রাথমিক শিক্ষা আজ ধ্বংসের দ্বারে উপনীত। সাতক্ষীরা সদরের শিক্ষা অফিসার আব্দুল গনির বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও যেন প্রতিকার নেই। দায়সারভাবে তদন্ত হলেও কোন শাস্তির আওতায় আনা হয় না তাকে। ঘুষ খাওয়া তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে। এবার সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল গনির বিরুদ্ধে পুল প্যানেলের তথ্য গোপনে লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। এই শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে যেন অভিযোগের অন্ত নেই। 


রিপোর্টের পর রিপোর্ট হলেও অদৃশ্য কারণে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এতে করে শিক্ষক সমাজ হতাশ হয়ে পড়েছে। সূত্রমতে, একাধিকবার তার বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও দুর্নীতি ও অনিয়ম যেন আব্দুল গনির নিত্যসঙ্গী। কোনভাবেই তার দুর্নীতির বলয় থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সাতক্ষীরার শিক্ষক সমাজ। এমন দুর্নীতিবাজ-ধূর্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি উপজেলার শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার জন্যই যথেষ্ট বলে মনে করছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সাধারণ শিক্ষকগণ। 


জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মিরপুর, ঢাকা থেকে ১ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে “৩৮.০১.০০০০.৪০০.১৯.০০২.২৩.১৩/১(২)” স্মারক মোতাবেক এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, সাতক্ষীরা কার্যালয়ের ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখের “৩৮.০১.৮৭০০.০০০.৩৭.০০৩.২২-১৯২/৮” স্মারক মোতাবেক “পুল ও প্যানেল হতে নিয়োগকৃত এবং ৭(খ) ধারায় পদায়নকৃত সহকারী শিক্ষকগণ যারা নিজ উপজেলা/জেলার বাইরে কর্মরত আছেন এরূপ শিক্ষকের তথ্য প্রেরণ” বিষয়ক শিরোনামে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল গনি কর্তৃক ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত “উশিঅ/সদর/সাত/২০২৪/১৭১” স্মারক মোতাবেক তথ্য প্রেরণ করা হয়। 


তার প্রেরিত তথ্য হতে দেখা যায়, পুল ও প্যানেল হতে নিয়োগকৃত সহকারী শিক্ষক ৬জন এবং ৭(খ) ধারায় নিয়োগ/পদায়নকৃত সহকারী শিক্ষক ৭জন সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় কর্মরত আছেন। কিন্তু আব্দুল গনি জেনে বুঝে কোন এক অজানা স্বার্থের কারণে সুদূর চাপাইনবাবগঞ্জে স্ত্রী-সন্তান ফেলে রেখে অফিসিয়াল সরকারি তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রেখে অসম্পূর্ণ তথ্য প্রেরণ করেছেন। যাদের তথ্য গোপন করা হয়েছে দৃষ্টান্ত হিসেবে তাদের কয়েকজন হলেন-নাসরিন সুলতানা, সহকারী শিক্ষক, ব্রহ্মরাজপুর সপ্রাবি এবং মোছাঃ শাহনাজ পারভীন, সহকারী শিক্ষক, ধুলিহর সপ্রাবিসহ অনেকেই। নিকটবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকারী শিক্ষক যারা আছেন তাদের তথ্য গোপন করা হয়েছে মর্মে জানা গেছে। 


এবিষয়ে অফিস সহকারী আব্দুল ওদুদ ও রিনা রানী জানায়, টিইও স্যার আমাদের নিকট যে তথ্য দেন সে মোতাবেক আমরা টাইপ করে পাঠিয়ে দেই। সহকারী শিক্ষা অফিসার মাসুম বিল্লাহ যে আব্দুল গনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং প্রতিটি দুর্নীতিতে সায় দিয়ে থাকেন তার কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে চাইলে বলেন, তথ্য আমরা ফিল্ড থেকে সংগ্রহ করে দিলেও টিইও স্যার তার ইচ্ছেমত কাটসাট করে দেন। আমাদের কিছুই করার থাকে না। 


আরও জানা যায়, মাসুম বিল্লাহ ব্রহ্মরাজপুর ক্লাস্টারের দায়িত্বে থেকে যোগরাজপুর ক্লাস্টার যায়। যোগরাজপুর ক্লাস্টারে বেশি সুবিধা করতে না পারায় ব্রহ্মরাজপুর ক্লাস্টারের দায়িত্ব লবিং করে নিয়েছে। এতে ব্রহ্মরাজপুর ক্লাস্টারের শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মাসুম বিল্লাহ রাতের আঁধারে টিইও আব্দুল গনির সাথে মিলে অফিসে এসে বিভিন্ন কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে দরখাস্ত করে দেয়। টাইপিস্ট হিসেবে মাসুম বিল্লাহ গনিকে সাহায্য করে। এটি জানার ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।


এর পূর্বে আব্দুল গনির বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৮মে “৩৮.০১.৮৭০০.২৭.০০৮.১৭-৭২০” স্মারক মোতাবেক শিক্ষক বদলিতে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্য (প্রমাণিত হয়), নিলাম ছাড়া স্কুলের ভবন ও গাছ বিক্রি, এডুকেশন ইমাজের্ন্সির টাকা আত্মসাৎ, সরকারি বরাদ্দ ছাড়ের নামে উৎকোচ গ্রহণ, সমাপনীর উত্তরপত্র বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ, জাতীয় দিবসে অনুপস্থিত (প্রমাণিত হয়), শিক্ষার গুণগত মান ক্ষুন্ন করা, দুটি সরকারি মোটরসাইকেল ব্যবহার (প্রমাণিত হয়), স্কুলে ও শিক্ষকের বাসায় দাওয়াত খাওয়া, অহেতুক হয়রানি, বিনা কারণে শোকজ নোটিশ প্রদান, দালাল শ্রেণির শিক্ষকদের সাথে বিশেষ সখ্যতাসহ মোট ১২টি বিষয়ের দুর্নীতি ও অনিয়মের উপর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসনে ইয়াসমিন করিমী। 


জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসনে ইয়াসমিন করিমী ২১জুন ২০২৩ তারিখে দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে ৩টি বিষয় তদন্তে প্রমাণিত লিখলেও তিনি আব্দুল গনির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোন সুপারিশ করেননি। টাকার বিনিময়ে দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ অহিদুল আলম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার খুলনা কর্তৃক তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদন সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।


উল্লেখ্য, বিগত ৩ বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত থাকা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল গনিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে বরিশালের হিজলায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে শাস্তিমূলক বদলির আদেশ করা হলেও কোন এক অজানা ক্ষমতার জোরে আব্দুল গনি তার বদলি ঠেকিয়ে সাতক্ষীরা সদরে থেকে যান। অথচ তার স্ত্রী ভোলারহাট চাপাইনবাবগঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত আছেন। এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল গনির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024