|
Date: 2024-03-19 06:54:43 |
“মরহুম শাহাবুদ্দীন আহমেদ ছিলেন এদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, সুদীর্ঘ জীবনে ন্যায় ও সততাকে সঙ্গে নিয়ে ছিল তাঁর পথচলা। নির্লোভ এবং ঋজু এই সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান হিসেবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারের দিশারী। ক্ষমতাবানদের অন্যায় নির্দেশের তোয়াক্কা না করে ন্যায়বিচার ও সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। দায়িত্ব পালনকালীন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি সাহস ও বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তা মোকাবেলা করেছেন। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী ও সৌজন্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারি। কর্তব্যপরায়ণ, আদর্শনিষ্ঠ ও সততার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটের সময় পৃথিবী থেকে তাঁর চিরপ্রস্থান গভীর বেদনা ও হতাশার। আজ থেকে ২ বছর আগে ২০২২ সালের ১৯ মার্চ জাতি হারায় তার এক গর্বিত সন্তানকে।
তিনি ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০
পেমই গ্রাম, কেন্দুয়া, নেত্রকোণায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চন্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রথমে লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমি এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদের কর্মজীবনের সূচনা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। এরপর তিনি গোপালগঞ্জ ও নাটোরের মহকুমা কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সহকারী জেলা প্রশাসক হিসাবে পদোন্নতি পান। এর পর ১৯৬০ সালে তিনি প্রশাসন হতে বিচার বিভাগে বদলি হন। তিনি ঢাকা ও বরিশালের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তাকে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭২ সনের ২০ জানুয়ারি হাইকোর্টের বেঞ্চে তাকে বিচারক হিসেবে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৮০ সনের ৭ ফেব্রুয়ারি তাকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা ল রিপোর্ট, বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিসন এবং বাংলাদেশ কেস রিপোর্টসে তার প্রচুরসংখ্যক রায় প্রকাশ করা হয়। চাকুরিসম্পর্কিত, নির্বাচন নিয়ে কলহ, শ্রম ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক ইত্যাদি কেসে তার গৃহীত বিচারের রায় বহুল সমাদৃত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৮ম সংশোধনী সম্পর্কিত কেসে তার দেয়া রায় যুগান্তকারী এবং বাংলাদেশের সংবিধানের পরিশোধনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালের মধ্য-ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু লোক নিহত এবং অনেক লোক আহত হয়েছিল। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেই ঘটনার তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদের রাজনীতিতে আসাটা কিছুটা নাটকীয়। ৫ ডিসেম্বর ১৯৯০, মওদুদ আহমেদ উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শূন্য রাষ্ট্রপতির পদে এবং নির্বাচন হবার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানরূপে কে আসীন হবেন তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছিল না। এক দল অন্য দলের প্রার্থীর প্রতি অনাস্থা পোষণ করছিল। অবশেষে যখন বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নাম এলো,তখন দুটি দলই ঐকমত্য পোষণ করল যে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন-ই একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ বাংলাদেশের ৫ম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি আবার তার মূল পদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই তিনি আওয়ামী লীগের দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদে মনোনয়নের পর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। যদিও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খুবই সীমিত, তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সততা এবং প্রজ্ঞা দ্বারা বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান জয় করেন। ১৪ই নভেম্বর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের সাথে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল বলে ধরা হয়। তিনি ২০২২ সালের ১৯ মার্চ, সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে ৯২ বছর বয়সে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ এর মতো একজন গুণী মানুষের ২য় মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
মোঃ নাজমুল হাসান: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
Email: pressnazmulbd@gmail.com
© Deshchitro 2024