# আজ বিশ্ব পানি দিবস

# অর্ধেকে নেমেছে পৌরসভার কূপ থেকে পানি উত্তোলন

# বাড়ছে ভূমিধসের ঝুঁকি, ক্ষুন্ন হচ্ছে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য

# জেলার ৯৭. ৬৪ শতাংশ মানুষের পানির উৎস নলকূপ

# সংকট সমাধানে বেশি পরিমাণে বৃক্ষ রোপন, পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে


কক্সবাজার পৌরসভায় বিস্তৃত হচ্ছে নগরায়ন। বাড়ছে জনসংখ্যা। বহুমূখী চাপে বেড়েছে সুপেয় পানির চাহিদাও। তবে গত এক দশক ধরে এ জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিম্নমুখী। এ যেনো সাগরপাড়ে সুপেয় পানির বিপদ আসন্ন!

শুধু পৌর শহর নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, কক্সবাজার শহর এবং উপজেলাগুলোতে প্রতিবছর গড়ে ১০-১৫ ফিট ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে যাচ্ছে। আগে ১২০-১৫০ ফিটে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যেতো, এখন তা ৩০০ ফিটের গভীরে নেমেছে। নলকূপ দিয়ে উঠছে লবণ পানি। এই ধারাবাহিকতা থাকলে আগামীতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।


পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জনশুমারি ও গৃহ গণনার চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার জেলার ৯৭. ৬৪ শতাংশ মানুষের পানির উৎস গভীর-অগভীর নলকূপ। এর বাইরে ০.৬১ শতাংশ সরবরাহকৃত, 0.৭৯ শতাংশ বোতলজাত, 0.৬৩ শতাংশ ভালপানি এবং ০.১৪ শতাংশ পুকুর, খাল, নদী ও লেকের পানি পান করেন।

এমন পরিস্থিতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ২২ মার্চ পালিত হবে ‘বিশ্ব পানি দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘ওয়াটার ফর ফিস’ বা ‘শান্তির জন্য পানি’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালিত হবে।


যে কারণে নেমে যাচ্ছে স্তর :

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কম হওয়া, তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি, পুকুর, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করে হোটেল-মোটেল, আবাসিক ভবন ও রাস্তাঘাট তৈরীর কারণে জলাশয় কমে যাওয়া, শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, `পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৃক্ষ নিধনের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কমছে।’

অধ্যাপক শফীকুল ইসলাম বলেন, `পানির স্তর নিচে গেলে ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হয়। ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝোঁকও বাড়ে। পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায়, এতে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়।‘

বনবিভাগের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে কক্সবাজার জেলায় ১২ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক ধ্বংস বন করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা’র) সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘কক্সবাজার অঞ্চলে বৃক্ষনিধন ও পাহাড় কর্তনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকালে কৃষিজমি, নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল পরিস্থিতি লাভ করেছে।’

শরীফ জামিলের আশঙ্কা, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার না করলে আগামীতে এই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নামবে।’


সরজমিনে নুনিয়ারছড়া:

কক্সবাজার পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের শেষপ্রান্তে উত্তর নুনিয়ারছড়া। এলাকাটির উত্তরে মহেশখালী চ্যানেল। পূর্বে বাঁকখালী নদী। অবস্থান একেবারে নদীর লাগোয়া। কিন্তু চারপাশে পানি থাকলেও এখানকার বাসিন্দাদের খাবার পানির দুঃখ যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছে, দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন।

গত বুধবার বিকেল ৩টার দিকে গৃহিনী জরিনা খাতুন বলছিলেন, ‘৩ বছর ধরে পানির সমস্যা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছি। নলকূপ দিয়ে যে পানি উঠে, তাও লবণাক্ত। আছে আর্সেনিক। কোনো উপায় নেই। পানির কারণ শারীরিক নানা সমস্যায় ভূগছি।’

আবদুর রহমান (৭৪) এর ভাষ্য, বছর দশেক আগে ওই এলাকা মিঠাপানি পাওয়া যেতো। তবে সম্প্রতি ৭০০ ফিট গভীরে গিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘এখন যেটা পাচ্ছি এটা প্রথম স্তরের পানি। এটার গভীরতা ১০-১৫ ফিট, এই পানি দূষিত।’

তাদের সাথে আলাপকালে এগিয়ে এলেন গৃহিনী আনজুমান আরা, শাহিদা বেগম, রুনা লায়লা, রাশেদা বেগম। এর মধ্যে আনজুমান বলেন, ‘এখানকার ৩০ পরিবারের সদস্যরা দুই কিলোমিটার দূরের মসজিদের গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করে।’

রাশেদা বেগমের ভাষ্য, ‘পানির কারণে গোসল, রান্নাবান্না, কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানান ধরনের চমরোগ । ১০-১২ বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।’

শুধু পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড নয়। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকার চিত্র একই। কোথাও কোথাও কিনে খেতে হচ্ছে পানি।


বন্ধ পৌরসভার ৩ কূপ :

কক্সবাজার পৌরবাসীর জন্য দৈনিক কি পরিমাণ সুপেয় পানির প্রয়োজন সেই পরিসংখ্যান কোন দপ্তর কিংবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কাছে নেই।

তবে এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের প্রায় ৩ হাজার গভীর নলকূপ ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হয়। এই পানি ২ লাখ বাসিন্দা এবং ১ লাখ পর্যটকের চাহিদা মেটায়।

কক্সবাজার পৌরসভার তথ্যমতে, পৌরসভার অধীনে ১০টি কূপ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার গ্যালন পানি উত্তোলন করা হতো। কিন্তু ৩-৪ বছর ধরে পানি উত্তোলন নেমেছে ৩৫-৪০ হাজার গ্যালনে। উত্তোলন করা পানিগুলো ১ হাজার ৪০টি পরিবারকে সরবরাহ করা হয়।

পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১০টি কূপের মধ্যে ৩-৪টি কূপের পানি ভালো পাওয়া গেলেও বাকীগুলোতে ভূগভে পানি না থাকায় বন্ধ রয়েছে। ৭-৮ বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে চলমান এই সমস্যার কারণে শহরের বাসিন্দা ও মোটেল-মোটেলে পানির চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এডিবির অর্থায়নে নির্মিত সারফেস ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্লান্টটি শীঘ্রই চালু হবে। এটি চালু হলে প্রতি ঘন্টায় ১০ লক্ষ লিটার করে দৈনিক ৮ ঘন্টায় ৮০ লক্ষ লিটার সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। এতে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে।’


কুতুবদিয়া-মহেশখালীতে লবণাক্ততা :

কুতুবদিয়ায় সুপেয় পানির সংকটে ধুঁকছে। অকেজো হয়ে পড়েছে অগভীর নলকূপ। উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং এবং লেমশীখালী ইউপিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ১০-২০টি পরিবার মিলিয়ে একটি নলকূপ থাকলেও কোন এলাকায় নলকূপ নেই।

অপরদিকে মহেশখালী পৌরসভা, কুতুবজোম, মাতারবাড়ি, ধলঘাটায় লবণাক্ততার পরিমাণ ভয়াবহ আকারে ধারণ করেছে।

কুতুবদিয়ার স্থানীয় পরিবেশকমী ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কুতুবদিয়ার আহবায়ক এম. শহীদুল ইসরাম বলেন, ‘দ্বীপে কিছু এলাকায় ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট নিচে সুপেয় পানির স্তর কোথাও আবার ১২শ ফুট গভীরে নলকূপের পাইপ বসাতে হচ্ছে। বিশেষ করে, বৃহৎ পাইলটকাটা খাল ভরাট, দখল-দূষণে নাব্যতা না থাকায় বিগত ৩-৪ বছর যাবৎ লবণ চাষীরা পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ লবণ পানি উত্তোলন করে লবণ চাষ করছেন।’

শহীদুল বলেন, ‘কৃষকরা গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে ধান ও লবণ চাষ করছে। এ কারণে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে।’

ধরা’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘উজানে বাংলাদেশের বাইরে ও ভেতরে নদীগুলো যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে পানি প্রবাহে ব্যাপক সংকট তৈরী হয়েছে। গেল চার দশকে উপকূলে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিগুণ হয়েছে।’


সমাধানে করণীয়:

সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপের কথাও বলেছেন চবির অধ্যাপক ড. মো. শফীকুল ইসলাম। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেশি পরিমাণে বৃক্ষ রোপন, পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং অপরিকল্পিতভাবে খাল বিল ভরাট করে নগরায়ন না করা।

ড. মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত; বেশি পরিমাণে বৃক্ষ রোপন করলে জলবায়ুও ওপর পজেটিভ ইমপ্যাক্ট আসবে। বৃষ্টিপাত বেশি হবে, তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

দ্বিতীয়ত; খাল বিল ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। এতে খালবিল ও ফাঁকা জায়গাতে সারফেস ওয়াটার বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যাবে। এটা একদিকে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করবে, অন্যদিকে ভূগভস্থ পানির স্তর উপরে ওঠাতে সাহায্য করবে।

তৃতীয়ত; পাহাড় কাটা বন্ধ রাখলে পরিবেশেও ওপর পজেটিভ ইমপ্যাক্ট রাখবে।

আর এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। তাহলে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এটা শুধু কক্সবাজার নয়, ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলোর জন্যও প্রযোজ্য।

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024