একজন আধুনিক শিক্ষার কারিগর ও স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষাবিদ  এ কে মাহমুদুল হক 

                মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন 

ইতিহাসে এমন অনেক লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, পৃথিবী থেকে চলে গেলেও আজীবন  তাঁরা জীবিত। কেবল নামই নয়, বরং নামের সাথে তাদের চরিত্র ও গুণাবলীরও ফুঠে উঠে। বাংলাদেশের  চট্টগ্রাম জেলার  যে কজন ব্যক্তিত্ব তাদের কীর্তিতে আজীবন মানুষের মনের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছেন কিংবা থাকবেন  তন্মধ্যে এ. কে. মাহমুদুল হক  অন্যতম। ১৯৩৫ সালের ১লা এপ্রিল বীর চট্টলার ঐতিহ্যবাহী থানা ফটিকছড়ির মৌলবী বাড়ি হাইদচকিয়ায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা আমিনুল হক ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। তার  মাতার নাম ছফুরা খাতুন। 
 জনাব মাহমুদুল হকের ছাত্র জীবন ছিল অত্যন্ত গৌরব দীপ্ত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রথম জীবনে তিনি সফলতার সাথে দাখিল, আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে নওয়াব ফয়জুন্নিসা (গভঃডিগ্রি) কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ১৯৫৯ সালে ডিগ্রি এবং ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে  এম.এ. বাংলায় ২য় শ্রেণি লাভ করে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।
বলা যায় ছাত্র জীবনের সূচনা হতেই তাঁর শিক্ষকতার জীবনের শুরু। হাটহাজারী থানার মির্জাপুর হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে  দশ বছর (১৯৫২-৬১) শিক্ষকতা করেন। পরবর্তী জীবন কাটিয়ে দেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রাচীন বিদ্যাপীঠ ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের’ সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬১-১৯৭০ পর্যন্ত দশ বছর সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং ১৯৭১ হতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০০০ ইং পর্যন্ত ২৯ বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সদস্য হিসেবে তিন বছর এবং এস.এস.সি পরীক্ষার বাংলা বিষয়ে সুদীর্ঘ ২০ বছর প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
 শিক্ষাবিদ এ.কে. মাহমদুল হক  ১৯৯২ সালে জাতীয় পার্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, ১৯৮৪ সালে  জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত হন। এমনকি তিনি ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম রোটারী ক্লাব অব ইসলামাবাদ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক এবং ২০১৫ সালে  বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাশে কতৃর্ক তাঁকে একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ হিসেবে  গুণীজন সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তাছাড়া  তিনি অসংখ্য  সামাজিক সংগঠন থেকে সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন।
চট্টগ্রামের একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ এ কে মাহমুদুল হক শুধু  একজন ব্যক্তি নন। বরং তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান। আরবী, উর্দু ও ফার্সি ইত্যাদি ইসলামী শিক্ষায় অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি উত্তম আদর্শ ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নম্রতা ও বিনয়বনতা, দানশীলতা, তাকওয়া ও পরহেজগারী এবং আশেকানে রাসূল প্রভৃতি গুণাবলীতে তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। ব্যবহার ছিল অমায়িক, সুমধুর এবং নিরহংকার। তিনি ছিলেন বড় অন্তরের অধিকারী। মহান  এই শিক্ষাবিদের সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবস্থায়। সেই সময়ে আমি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার সুবিধার্থে সম্ভবত ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের সবার পরিচিত মুখ সংগঠক ও সমাজকর্মী নোমান উল্লাহ বাহার ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম পরিচয়। এরপর বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হলেও বেশী কনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়নি। ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ তাঁর কাছে বিদ্যমান ছিল। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহৃদয়তার মতো গুণের কারণে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একজন প্রচার বিমুখ দক্ষ সংগঠক ছিলেন। সমাজ কল্যাণ, শিক্ষার প্রসার ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের প্রাণকেন্দ্র বায়তুশ শরফ হতে প্রকাশিত পাঠক সমাজে সমাদৃত ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি পত্রিকা  ‘মাসিক দ্বীন দুনিয়া  ও শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়ায়’ এ.কে. মাহমুদুল হক  প্রধান সম্পাদক ছিলেন। বায়তুশ শরফের প্রায় প্রতিটি প্রকাশনা তাঁর সযত্নে সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছে। এ. কে. মাহমুদুল হক ‘চিটাগাং আইডিয়্যাল স্কুল এন্ড কলেজের’ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসাসহ অনেক স্কুল ও মাদ্রাসা পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, সহ-সভাপতি এবং সদস্যের দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করেছেন।
 শিক্ষক সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁর অবস্থান সবচাইতে অগ্রগামী । ১৯৮৬ সালে বেসরকারী শিক্ষক সমাজের চাকুরী জাতীয়করণের আন্দোলনের জন্য  ৩৩ দিন জেল খাটতে হয়। 
১৯৬১ সালে ১২ই মে জুমবার ফটিকছড়ির বখতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের  ডাঃ মরহুম আব্দুল মাবুদের কন্যা বেগম দিল আফরোজ খানমের সাথে  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার  সহধর্মিনী একজন বি.এ, বি.এড  আদর্শ শিক্ষিকা। তিনি জনাব এ. কে. মাহমুদুল  হকের প্রতিটি কাজে প্রেরণা  যুগিয়েছেন।  এ. কে. মাহমুদুল হক ব্যক্তি জীবনে তিন পুত্র ও চার কন্যার জনক। ১ম পুত্র  নুরুদ্দিন মাহমুদ, সহকারী প্রধান শিক্ষক, চিটাগাং আইডিয়্যাল হাই স্কুল। ২য় পুত্র    মরহুম মহিউদ্দিন মাহমুদ (৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে মারা যান)  ৩য় পুত্র   জন আমিন উদ্দিন মাহমুদ, স্পেন প্রবাসী। ১ম কন্যা আমেনা শাহীন। আমেরিকা ও বাংলাদেশ উভয় জায়গায় আসা যাওয়া হয়। তিনি চিটাগাং আইডিয়্যাল হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ,চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের ডাইরেক্টর। ২য় কন্যা তাহমিনা পারভীন মিলেনিয়াম টাওয়ার জামাল খান,চট্টগ্রাম। তিনি প্রাক্তন শিক্ষক, চিটাগাং আইডিয়্যাল হাই স্কুল। ৩য় কন্যা  ডাঃ তাহেরা নাসরীন, নিউইয়র্ক, ইউ এস এ তে অবস্থানরত। কনিষ্ঠা কন্যা   সায়েরা জেসমিন, ঢাকা সচিবালয়ের অফিসার্স কোয়ার্টারে স্বামীর সাথে অবস্থানরত,গৃহিণী।
এ.কে. মাহমুদুল হক ছিলেন লেখালেখিতে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তিনি সহজ বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা-( চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি),নিম্ন মাধ্যমিক রচনা ও বিরচন (ষষ্ঠ, সপ্তম, ও অষ্টম শ্রেণি),শিক্ষক-শিক্ষণ-সমীক্ষা (ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের ১৩৫ বছরের ইতিবৃত্ত),Steps to learning English- (IV, V, VI, VII), সুন্দর হাতের লেখা (বাংলা), Cursive Hand Writing (English), Chimes for Children- (I, II, III)।
২০০৮ সালে  তাঁর আত্মজীবনী মূলক এক প্রাণবন্ত  শিক্ষামুলক ৫১২ পৃষ্ঠার  "জীবন স্রোতের আঁকে বাঁকে" নামে গ্রন্থ  প্রকাশিত হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই ২০২২ইং শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হসপিটালে বার্ধক্যজনিত রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ প্রবীণ শিক্ষক ৮৭ বছর বয়সে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দেন।ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাদ জুম’আ কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুশ শরফে রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী ম.জি.আ এর ইমামতিতে প্রথম জানাজা এবং বাদে আসর সরকারী হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজ মাঠে দেবপাহাড় জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মুহাম্মদ আবুল মকসুদ এর ইমামতিতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে এই মহান মনীষীকে মোল্লা মিসকিন শাহ মাজার মসজিদ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।  মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই শিক্ষাবিদকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করুক। শিক্ষক সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধাভাজন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্র সমাজের কাছে একজন প্রাণপ্রিয় মান্যবর উস্তাদ।আর সাধারণ জনগণের কাছে সম্মানিত, মান্যগণ্য ব্যক্তিত্ব।



লেখক: কলামিস্ট।
প্রচার ও প্রকাশনা সচিব, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।




প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024