|
Date: 2024-05-15 21:16:09 |
যখন কোনো কারণে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না তখন ওই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে।
বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এই খেলাপি ঋণ। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও তা আজও হাতের নাগালের বাইরে।
বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। তবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের আদালতগুলোয় খেলাপি ঋণের অভিযোগে প্রায় ৭২ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
গত বছর ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ সালে সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হচ্ছে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির সংখ্যা সাত লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন।
তিনি জানান, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির মধ্যে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,৭৩২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণ ১,৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,৮৫৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণ ১,৫২৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,০৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এদের পুরোটাই খেলাপি ঋণ। রাইজিং স্টিল কোম্পানি লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,১৪২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণ ৯৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তাদের পুরোটাই খেলাপি ঋণ। রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যার লিমিটেডের স্থিতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ একই। তাদের খেলাপি ঋণ ৮৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ক্রিসেন্ট লেদার্স প্রোডাক্ট লিমিটেডের স্থিতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমস লিমিটেডের স্থিতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেডের ঋণের স্থিতি এক হাজার ১৩১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
বি আর স্পিনিং মিলস লিমিটেডের স্থিতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এস.এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,১৭২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭০৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। রেডিয়াম কম্পোজিটর টেক্সটাইল লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৭৭০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সামান্নাজ সুপার অয়েল লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ১,১৩০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫১ কোটি ৭ লাখ টাকা।
মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশিয়ান এডুকেশন লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৬৫৩ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এস.এম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৮৮৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৮৭২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এহসান স্টিল রি-রোলিং লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৬২৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং সিদ্দিকী ট্রেডার্সের ঋণের স্থিতি ৬৭০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এই খেলাপি ঋণের জন্য সাধারণত ব্যাংকে যখন টাকার পরিমাণ কমে যায়, আমরা সেটাকে তারল্য সংকট বলি। আর যখন তারল্য সংকট হয় তখন ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতাও কমে যায়। ব্যাংকের টাকা অর্থনীতিতে 'জ্বালানির মতো' কাজ করে। এই খাতের বড় অংকের টাকা ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেলে গোটা অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
তখন ব্যাংকের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ফলে স্বাভাবিকভাবে সরকার ব্যাংকের থেকে কম কর পায়। আর সরকার কম কর পেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যয় কমে যাবে। তাছাড়া ব্যাক্তি পর্যায়ে যারা বিনিয়োগে যেতে চান তারা ঋণ পান না, তাই বিনিয়োগে যেতে পারেন না। আর বিনিয়োগ কমে গেলে অর্থনীতির ওপর নানা প্রভাব পড়ে। ফলে অর্থনীতির ‘গ্রোথ’ কমে যায়। কমে যায় কর্মসংস্থানের সুযোগ। যা এটি চক্রাকারে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করে তোলে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়া।
সেই সাথে রয়েছে, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনে ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানির পরিচয়।
একটা দুঃখজনক বাস্তবতা হলো শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির মতো লক্ষ লক্ষ হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপি করেও দিব্যি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ মুদ্রার অন্যপীঠ দেখতে পাই একজন সাধারণ মানুষের বেলায় যারা সামান্য কিছু লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তাদের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ের একটা ঘটনা নভেম্বর ২০২২ সালে পাবনায় মাত্র ২৫-৩০ হাজার টাকা লোনের মামলায় ১২ কৃষককে জেলে পাঠানো হয়েছে জেল খাটতে। কিন্তু রাঘব-বোয়ালরা ঠিকই আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে বিজনেস ক্লাসে দেশ-বিদেশ দাপটের সহিত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করছে। যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
আমি মনে করি আমাদের উচিত এই বিষয়ে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। বিরোধীদল গুলো শুধু রাজনৈতিকভাবে বিরোধীতা না করে এইসব বিষয়েও সোচ্চার হতে হবে পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিনিয়ত আমরা অনেকে বিষয়ে বিভিন্ন মানববন্ধন দেখি। আমাদের জনগণের উচিত এই খেলাপি ঋণ নিয়েও মানববন্ধন করা। দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া গুলো এ বিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ, অনুসন্ধানী রিপোর্ট, ডকুমেন্টারি তৈরির মাধ্যমে অবদান রাখতে পারে। তাছাড়া অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রম বিস্তৃতির মাধ্যমে বিচারাধীন মামলা গুলো দ্রুততার সহিত নিষ্পত্তি করা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। পাশাপাশি ঋণ খেলাপি সমস্যা সমাধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অল্টারনেটিভ ডিসপুট রেজুলেশন (এডিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে এ বিষয়ে সমাধানে আসা। এভাবেই দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশাল খেলাপি ঋণের কালো থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।
লেখক: মোঃ নাজমুল হাসান: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
Email: pressnazmulbd@gmail.com
© Deshchitro 2024