মো: আজগার আলী, সদর উপজেলা প্রতিনিধি সাতক্ষীরা: শহরের ঝুটিতলায় বসবাস। বাবা ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী শাহেদ আলী পাঁচ বছর আগে বিয়ে বাল্যবিবাহ দেন তাকে। স্বামী রকিব হোসেন শ্রমিকের কাজ করেন। বিয়ের তিন বছর পর এক পুত্রসন্তানের মা হন তিনি। কিন্তু সংসারে খুব অভাব। শরবত বিক্রি করে লেবু, চিনি ও বিট লবণের খরচ তুলে কোনো দিন ১০০ বা কোনো দিন ১২০ টাকা লাভ হয় তার, যা সংসারে কিছুটা হলেও উপকারে আসে। নাম শামিমা খাতুন, বর্তমান বয়স ১৯। বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে, যখন তার স্কুলে থাকার কথা ছিল, কথা ছিল অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করার। শামিমা মা হন ১৭ বছর বয়সে। এখন তার কোলে দুই বছরের সন্তান। তাকে নিয়েই সাতক্ষীরা শহরের নিউমার্কেট মোড়ে বিক্রি করেন লেবুর শরবত। শ্রমিক স্বামীর সংসারে একটু ভালো থাকতে দুই সপ্তাহ ধরে শরবতের ব্যবসা শুরু করছেন বলে জানান তিনি। তবে ফুটপাতের ওপর খোলামেলা অবস্থায় অনেকে খেতে চায় না তার শরবত। তবু চেষ্টার কমতি নেই। পথচারীরা সামনে দিয়ে গেলেই শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। শামিমা খাতুনের মতো আরো অনেক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বলে জানান বাল্য প্রতি‌রোধ সাতক্ষীরা জেলা ক‌মি‌টির সদস্য ও মানবা‌ধিকার কর্মী সা‌কিব হো‌সেন বাবলা। তিনি বলেন, ‘‌সাতক্ষীরায় বাল্যবিবাহ ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রতি বছর পাঁচ-ছয় হাজার কি‌শোরীর বি‌য়ে হ‌য়ে যা‌চ্ছে। সপ্তম থে‌কে নবম শ্রেণী‌তে পড়া অবস্থায় অধিকাংশ মেয়ের বি‌য়ে হ‌চ্ছে।’ তি‌নি জানান, জেলায় মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা র‌য়ে‌ছে ছয় শতা‌ধিক। এর ম‌ধ্যে পাঁচ শতা‌ধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বা‌কিগু‌লো মাদ্রাসা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তম থে‌কে নবম শ্রেণীর ছাত্রী‌দের প্রতি বছর শ্রেণীভে‌দে অন্তত ১০ জন ক‌রে উপ‌স্থি‌তি ক‌মে যা‌চ্ছে। পরে খোঁজ নি‌য়ে জানা যায়, তা‌দের বি‌য়ে হ‌য়ে গে‌ছে। ‌গত তিন-চার বছ‌রে তারা অন্তত ৮০০ বাল্যবিবাহ বন্ধও ক‌রে‌ছেন। এদিকে বাল্যবিবাহের কারণে জীবনটা বিপর্যস্ত হয়েছে বলে জানান সাতক্ষীরা শহরের গড়েরকান্দা গ্রামের সাহারাত হোসেনের মেয়ে জাহানারা খাতুন (২২)। তার কন্যাসন্তানের বয়স এখন সাড়ে নয় বছর। ১৩ বছর বয়সে মা হন জাহানারা খাতুন। এখন তালাকপ্রাপ্ত হয়ে দরিদ্র বাবার সংসারে ঠাঁই হয়েছে তার। জাহানারা খাতুন বলেন, ‘‌পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ভ্যান চালক বাবা পাশের কুখরালী গ্রামের মারুফ সরদারের ছেলে রফিকুল কবিরের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন। তখন বয়স ১২ বছর।’ সন্তান প্রসবের পর থেকে জাহানারা খাতুন অপুষ্টিসহ নানা রোগে ভুগছেন। বর্তমানে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় এক চিকিৎসক বলেছেন, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তিনি। জাহানারা খাতুন জানান, মেয়ের বয়স যখন এক বছর তখন স্বামী রফিকুল কবির তাকে বাবার বাড়িতে ফেলে চলে যায়। এর কিছুদিন পর তাকে তালাক দেয়া হয়। সেই থেকে বাবার বাড়িতে তার অবস্থান। নিজের ওষুধ ও কন্যার স্কুলে পড়ার খরচ জোগানোর মতো অবস্থা বাবার নেই। তাই অসুস্থ হয়েও এলাকার এক বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনোমতে বেঁচে আছেন তিনি। বাল্যবিবাহের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে সবচেয়ে বেশি বলে জানান সাতক্ষীরা জর্জ কোর্টের আইনজীবী বদিউজ্জামান বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘‌সাতক্ষীরার বিভিন্ন আদালতে তালাক বা যৌতুকসংক্রান্ত হাজার হাজার মামলা রয়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে এসব মামলা। অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার কারণে মূলত এসব ছেলেমেয়ের বিচ্ছেদ ঘটছে।’ সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈচনা গ্রামের মহিদুল ইসলাম মেয়ে মনিরা খাতুনের অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন মাহমুদপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের দেড় বছর পর এক কন্যাসন্তান হয় তার। এর পর থেকে তার ওপর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকে। একপর্যায়ে যৌতুকের দাবিতে তাকে তার বাবার বাড়ি তাড়িয়ে দেয়া হয়। মেয়ের ওপর এমন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিবাহবিচ্ছেদ করাতে বাধ্য হন বাবা। এর পর থেকে বাবার বাড়িতে রয়েছেন মনিরা খাতুন। দরিদ্র বাবা-মায়েরা ঝুঁকি এড়াতে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জ্যোৎস্না দত্ত। তিনি বলেন, ‘শিশুর কোলে শিশু বড় হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে দারিদ্র্য ও অশিক্ষা, যা আইন দিয়েও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও আমাদের চেষ্টা করতে হবে বাল্যবিবাহ বন্ধে আরো সচেনতন করা যায় কীভাবে।’ বাল্যবিবাহ নারীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনিবিশেষজ্ঞ ডাক্তার রহিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘‌একজন কিশোরী যখন সন্তান প্রসব করে তখন সে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার নবজাতকও অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একজন অল্প বয়সের মা তার নিজের শারীরিক সমস্যা দেখবেন না সন্তানের দিকে খেয়াল করবেন?’ বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘‌বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে এর ভয়াবহতা আরো বেশি। এসব মেয়ে অল্প বয়সেই সন্তান প্রসব করে।’ বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকার নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে জানান সাতক্ষীরা জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক একেএম শফিউল আযম। তিনি বলেন, ‘২০২২ সা‌লের জানুয়ারি থে‌কে ২০২৪ সা‌লের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫০৪টি বাল‌্যবিবাহ বন্ধ করা হ‌য়ে‌ছে। এর ম‌ধ্যে ২০২২ সা‌লে ১৮৪‌টি, ২০২৩ সা‌লে ২৪৫ ও চল‌তি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৭৫ টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে।’ তি‌নি আরো ব‌লেন, ‘‌তাৎক্ষ‌ণিকভা‌বে বন্ধ কর‌লেও এদের অধিকাংশের ক‌য়েক‌ দিন যে‌তে না যে‌তেই বি‌য়ে হ‌য়ে গে‌ছে। ত‌বে বাল্যবিবাহের কো‌নো তথ্য সরকারি অফি‌সে সংরক্ষণ নেই।’
প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024