|
Date: 2024-07-03 10:19:47 |
সিরাজগঞ্জে ভূমি অফিসে সরকারি নিয়ম বহির্ভূতভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি অসাধু চক্র। টাকার বিনিময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে ভূমি অফিসে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দালালদের দৌরাত্ম। জমির মালিকানায় পরিবর্তন, কর আদায়, পর্চা উত্তোলন, ওয়ারিশিয়ান সনদ, পরামর্শসহ কাগজপত্রাদী সহজীকরনের জন্য দালালদের সহযোগিতায় একমাত্র ভরসা হিসেবে বেছে নিতে হয় ভূমি অফিসে আগত সেবাগ্রহীতাদের।
এদিকে ভূমি অফিস ঘিরে টাকার বিনিময়ে নামজারী (জমাখারিজ) করার অভিযোগ উঠেছে কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিভিন্ন অনিয়ম, অনৈতিক ও ঘুষ বাণিজ্য বন্ধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত চিঠি প্রেরণ করেছেন বলে অভিযোগসূত্রে পাওয়া গেছে।
এ কাজের সাথে ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার, কানুনগো শামীম রেজাসহ দালাল চক্রের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে।
অভিযোগসূত্রে জানা যায়, ভূমি অফিস ঘিরে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের দৌরাত্ম বেড়ে উঠায় টাকার বিনিময়ে অসম্ভবকেই সম্ভব করছে। মিলছে একদিনেই খারিজ (জমাভাগ)। খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের আসিফ বাবু জমাভাগ (নামজারীর) আবেদন করে যাহার কেস নং- ১৪,১৬৫/২২-২৩। সংশ্লিষ্ট খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের নিকট কাগজপত্র জমা দিলে ভায়া দলিল অনুযায়ী জমিতে পর্যালোচনা করে দেখতে পায় জমিতে অংশ কাতে উল্লেখ করা আছে। পরে আবেদনটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেসটি বাতিল করে। পরে অফিসের নাম প্রকাশ্য অনিচ্ছুক দালালের সাথে কথা বলে মোটা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র সাথে চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২৫৯৬/২৩-২৪ কেস মূলে প্রস্তাব পাশের মাত্র একদিনেই খারিজ হয়ে যায়।
অপরদিকে, সাটিকাবাড়ী গ্রামের আনিছার রহমান ২৭/১২/২০০১ সালের ক্রয়কৃত ৮৬৭০নং দলিল মূলে সাড়ে এগার শতক জমি নামজারীর (জমাভাগ) আবেদন করে। যাহার কেস নং-৯৬৮৩/২২-২৩। ওই দলিলে জমির অংশ কাতে উল্লেখ থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বাতিল করে দেয়। পরে সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র পরামর্শে দলিল জাল করে পুনরায় আবেদনের ৯৬৮৩/২২-২৩ কেস মূলে সাড়ে ১১শতক জমি মোটা অঙ্কের বিনিময়ে প্রস্তাব পাশের মাত্র একদিনেই নামজারী (জমাভাগ) পাশ হয়।
শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিলন্দা গ্রামের শাহাদতের পুত্র রুবেল শিলন্দা মৌজার দেড় শতক জমি ৭৪৩৭ ও ২৩৫২নং দলিলমূলে ক্রয় করেন। গত বছরের ১৩ আগস্টে আবেদনের প্রেক্ষিতে ১১০৫ খতিয়ান ভুক্ত হয়ে নামজারী (খারিজ) পেয়ে যান। দখলে যাওয়ার বিষয়ে আর এস রেকর্ডসূত্রে মালিক ফিরোজগংরা জানতে পেরে শিয়ালকোল ভূমি অফিসে আসেন। জমিতে মালিকানা সত্ত্বে ভোগদখলে একজন অথচ জমিতে খারিজমূলর অন্যজন এসে বিশৃঙ্খলা করছে। জমির শ্রেনী ও ভোগদখল না দেখে খারিজের প্রস্তাবের বিষয়ে সহকারি কর্মকর্তা হাছান আলী বলেন, আমার পক্ষে ঘুরে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। নামজারী করাতে দলিলমূলে বাড়ী বাড়ী গিয়ে তল্লাশী করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
এবিষয়ে দলিলমূলে মালিক রুবেলের সাথে কথা বলে জানা যায়, খারিজ হয়েছে ঠিকই। কিন্তুু দলিলে দাগ ও সাইট না মেলায় আজও ওই জমিতে যেতে পারিনি। এখন আমার ওই অবস্থাতেই জমির প্রকৃত মালিকদের কাছে জমি দিতে হচ্ছে।
নাম না বলা শর্তে দালালচক্রের আরেক সদস্যের সাথে কথা বলে সেবাগ্রহীতা জানান, জমাভাগের জন্য নায়েব হাছান আলীর সাথে যোগসাজসে একটি জমির নামজারী বাবদ সাড়ে তিন লক্ষ টাকার কথা হয়েছে। টাকা বেশি হওয়ায় আমি এখন পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। ভূমি অফিসের পদোন্নতি হয়ে কানুনগো হওয়ার কথা শুনেছি। যদি ওই পদে হয়ে যান তাহলে নিমেষেই অন্যান্য জায়গারও সমস্যার সমাধান করা যাবে। সিরাজগঞ্জ জেলার নায়েবদের সভাপতি হওয়ায় তার পক্ষে সবই সম্ভব বলে তিনি জানান।
সেবা গ্রহীতারা বাইরে থেকে আবেদন করা হলে নিয়ম অনুযায়ী ২৮ দিনেই নামজারী হবে বলে জানিয়ে দেন সার্টিফিকেট পেশকার অথচ তার নিকট ৫’শ থেকে ১হাজার টাকা দিয়ে আবেদন করলে আবেদনের পিছনে সংখ্যা বসিয়ে চিহ্নিত করে নেয়। পরে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে প্রস্তাব পাশের পর মাত্র ৩-৪ দিনেই নামজারী পাশ করে দেওয়ার সহযোগিতা করে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রতিটি ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাটাগরী চিহ্নিত করে ফাইল পাঠিয়ে দেন। এ সকল ফাইল সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার, কানুনগো বিশেষ নজরদারীতে রাখেন বলে একাধিকসূত্রে জানা গেছে।
এত কিছুর পরও প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে স্বপদে থেকে প্রতিদিন অনিয়ম দুর্নীতি করে যাচ্ছেন যা প্রকৃত ভূমি মালিকদের সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বিঘ¥ ঘটছে। তবে এ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সদর এসিল্যান্ড এর সঙ্গে বেশ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এ সকল কাজ করে থাকেন বলে জানা গেছে।
অফিসকে জিম্মি করে কিছু দালাল চক্রের মধ্যে খোকশাবাড়ী গ্রামের কোরবান আলী, পৌর এলাকার ধানবান্দি মহল্লার আব্দুল খালেক, হরিনারায়নপুর গ্রামের রায়হান, রায়পুরের ছাইফুল, মাসুমপুরের আব্দুল মতিন, কাজিপুর উপজেলার রউফ, সরাইচন্ডি গ্রামের শাহ আলম ও শিয়ালকোল রঘুনাথপুর গ্রামের আব্দুল মমিনসহ আরো ১০/১২জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সরকারি অফিসের নথি গেটে যাবতীয় সমস্যার সমাধানের কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই দালাল সিন্ডিকেট।
এবিষয়ে সার্টিফিকেট পেশকার জাহিদ হাসান বলেন, নামজারী পাশ করার ক্ষেত্রে আমাকে সার্ভেয়ার অনুমতি দিলে পাশ করি, না দিলে আমি আমার মতো করে সঠিকভাবে দেখি। তবে আমি আবেদন করে ইনকাম করি।
সাবেক সার্ভেয়ার বর্তমান তাড়াশ উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত আব্দুল মোমিন মন্ডল জাল দলিল যাচাই করে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে মুঠোফোনে (০১৭১৮ ৬২২৯৮৬) তিনি বলেন, এটা আমার দায়িত্ব ছিল না এসিল্যান্ড স্যারের নির্দেশনায় কানুনগো স্বাক্ষর করার পর এটা যাচাই করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মাত্র একদিনেই পাশ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে কানুনগো মো. শামীম রেজা জানান, মাত্র একদিনেই নামজারী (জমাভাগ) পাশ হওয়ার বিষয়ে এড়িয়ে যান এবং রিপোর্ট না করার জন্য অনুরোধ করেন।
এসব বিষয়ে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গনপতি রায় কে অবহিত করলে তিনি প্রতিবেদককে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর কেস নম্বর দিতে বলেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানান।
© Deshchitro 2024