|
Date: 2024-07-27 10:03:25 |
◾সাজ্জাতুল ইসলাম শাওন : ১৯৭১ সালে বহু আত্নত্যাগ আর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ ই এপ্রিল ঘোষিত হয় 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আদেশ'এবং সে ঘোষণা অনুযায়ী সেদিনই 'স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ' গঠন করা হয়।১৭ ই এপ্রিল 'স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' (মুজিবনগর সরকার) শপথ গ্রহণ করে। যুদ্ধ করে আমরা যে দেশটা স্বাধীন করেছি তা গণতন্ত্রের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যেকোনো ধরণের সিদ্ধান্ত এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হবে।অথচ এই জায়গাটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এক শুভংকরের ফাঁকির মধ্যে পড়ে আছে।সারাদেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নেই কোনো কার্যকর ছাত্রসংসদ। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে দূরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছে।
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কথা বলা,অসচ্ছ্বল শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত ব্যাবস্থা,ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন,বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, হলে সিট বন্টনে প্রভোস্ট কে সহযোগিতা সহ শিক্ষা ও শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট জাতীয় ইস্যু তে কথা বলার মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের সুযোগ করে দেয় ছাত্র সংসদ।
অথচ গঠন্তন্ত্রের বুলি আওড়ানো দেশে বহুকাল ধরে নিষ্ক্রিয় ছাত্র সংসদ।বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে দেয় না।অথচ শিক্ষক সমিতির নিয়মিত নির্বাচন হয়,সিনেট,সিন্ডিকেট কমিটির নির্বাচন হয়,বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির কর্মচারীদের ও নির্বাচন হয়;কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না।এসব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নির্বাচন যে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ,১৯৭৩ এর আলোকে সংশ্লিষ্ট সকলের গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা তা শিক্ষার্থীরা জানে এবং বোঝে।তবে তাদের বেলায় কেন এ নীতি খাটে না?এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।এ জন্য তারা শিক্ষক সমাজকেই দায়ী করে।এ বিশ্বাস যেমন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর,তেমনি এর প্রভাব জ্ঞানচর্চা আর মূল্যবোধ গঠনেও পড়ছে।
আজকাল সুধীমহলে শুধু আলোচনা হয় অমুক নেতার নেতৃত্বের অভাব,নারী কেলেঙ্কারী,ঘুষ, দূর্নীতি আর চাঁদাবাজি,জমি দখল নিয়ে।তখন তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখা হয়। অনেক কে পাওয়া যায় সাবেক আমলা, কেউ আত্নীয় কোটায়,কেউ টাকার জোরে নেতা বনে গেছেন।অথচ যারা 'ছাত্ররাজনীতির' মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে ছাত্র সংসদ থেকে উঠে এসেছেন তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে খুব একটা এমন রেখা পাওয়া যায় না।বরং আমরা দেখতে পাই ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংদের নেতৃবৃন্দ।
ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ যেহেতু এসেই পড়লো তখন এ বিষয়ে কিছু কথা বলা উচিত।বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক যেসব সংগঠন রয়েছে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি যতটা না মুখাপেক্ষী তার চেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী নিজ দলের সিনিয়র নেতার।নিজ সংগঠনে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যাস্ত।তারা কতটা সাধারণ শিক্ষার্থী বান্ধব সে প্রশ্ন বারবার তৈরি হয়।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে প্রায় তিন দশকের অচলায়তন ভেঙে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।এ নির্বাচন অনুষ্ঠানেও ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট অনীহা। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ,সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ,সুধীমহল বারবার এ নির্বাচনের কথা বললেও কর্তৃপক্ষ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ই করে নি।অবশেষে আদালতের আদেশে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।শিক্ষার্থীদের মাঝে আশার আলো জ্বলে উঠে।সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।কিন্তু সারাজীবন অন্ধকারে রেখে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যে আশা দেখেছিলো ছাত্র সমাজ তা পরক্ষণেই হত্যা করা হয়।এরপর আর নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাবস্থা করতে পারে নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজে একই অবস্থা। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ(জাকসু) নির্বাচন হয়েছে ১৯৯২ সালে,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ(রাকসু) অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯০ সালে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ(চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯০ সালে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াতে যেমন ছাত্ররা অধিকার আদায়ে ব্যার্থ হচ্ছে, তেমনি দেশ কোনো মেধাবী নেতৃত্ব পাচ্ছে না।অপরদিকে নব্বই দশকের পর থেকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য,হল দখল, গেস্টরুম কালচার থামছেই না।বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়ত্ত্বশাসন থাকায় শিক্ষদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না।ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা গেলে যেমন সাধারণ ছাত্রদের অধিকার রক্ষা হবে, হয়রানি কমবে।ছাত্র সংগঠন গুলোর নেতারাও ছাত্র সংসদের মতো সম্মানিত জায়গায় আসীন হতে ছাত্রদের উপর সদয় হবে।পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গনতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্রমশ উন্নতি ঘটবে।তাই দ্রুত সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কার্যকর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অতীব জরুরি।
লেখক : সাজ্জাতুল ইসলাম শাওন
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
© Deshchitro 2024