|
Date: 2024-08-10 12:53:41 |
সম্প্রীতির শহর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সংখ্যালঘুদের মন্দির, গির্জাকে দুর্বৃত্তকারীদের হামলা ও ভাঙচুর থেকে রক্ষা করতে রাত জেগে পাহারা দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার বরুণা, শেখবাড়ি, মাদরাসাতুল কুরআনিল কারিমসহ কয়েকটি কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা।
জানা যায়, সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায় ও মন্দিরের ওপর হামলার খবর শুনে গত ৫ আগস্ট রাতে শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী বরুণা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শেখ বদরুল আলম হামিদী ও সদরে নায়েবে মুহতামিম মাওলানা শেখ নূরে আলম হামিদীর নির্দেশে বরুণার মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা উপজেলার বিভিন্ন মন্দির ও উপসনালয়ে রাতজেগে পাহারায় নিয়োজিত থাকেন।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাদরাসার-শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মন্দির-গির্জা পাহারায় রয়েছেন। একারণে উপজেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো মন্দির বা উপাসনালয় এখন পর্যন্ত ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। এমন কার্যক্রমে প্রশংসা ভাসছেন কওমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (১০ আগস্ট) বিকেলে শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মন্দির-গির্জা সংশ্লিষ্ট কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলার কোথাও কোনো মন্দির-গির্জায় ভাঙচুর বা হামলা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেসবুকে সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি ও মন্দির ভাঙচুর করা হচ্ছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব ঘটনার কোনো সত্যতা নেই।
গভীর রাতে সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শহরে শ্রী শ্রী শ্রীমঙ্গলেশ্বরী কালীবাড়ী, জগন্নাথ দেবের আখড়া, ভৈরব মন্দির, সার্বজনীন দুর্গাবাড়ী, ক্যাথলিক মিশন বারোয়াড়ী কালিবাড়ী, রামকৃষ্ণ মিশন, জগদ্বুন্ধু আশ্রম ও মিশন, ইসকন মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরের সামনে পাহারায় রয়েছেন শ্রীমঙ্গলের বরুণা ও মাদরাসাতুল কুরআনিল কারিমসহ উপজেলার কয়েকটি কওমি মাদরার ছাত্র-শিক্ষক।
মধ্যরাতে শ্রীমঙ্গল কলেজ রোডস্থ শ্রী শ্রী শ্রীমঙ্গলেশ্বরী কালী বাড়ী মন্দির গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন বরুণা মাদরাসার শিক্ষক সৈয়দ আতহার জাকওয়ান, জনপ্রিয় উর্দু নাশিদ শিল্পী শেখ এনাম, তরুণ আলেম নুহ বিন হোসাইন, বরুণা মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন ও আহমদ জুবায়ের জুয়েলসহ প্রমুখ।
পাহারারত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জানান, দেশে সরকার পতনের পর এক শ্রেণির দুর্বৃত্তরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে যাতে হামলা চালাতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্কতামূলক এই ব্যবস্থা নিয়েছি। কোন মন্দির, গির্জা বা প্যাগোডায় যাতে কোন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী কোন দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখছি।
শহরের জগন্নাথ দেবের আখড়াসহ বিভিন্ন মন্দিরের গিয়ে দেখা যায়, হাতে লাঠি নিয়ে মন্দিরগুলোর দাঁড়িয়ে আছেন বরুণা মাদরাসা ও সাগরদিঘী রোডের মাদরাসাতুল কুরআননিল কারিম এর শিক্ষার্থীরা। সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিতে পেলেই তারা জিজ্ঞাসাবাদও করছেন৷
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বলেন, শ্রীমঙ্গলে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপসনালয়গুলোতে দুর্বৃত্তদের হামলা ঠেকাতে বিভিন্ন মন্দির-গির্জায় রাতজেগে পাহারায় রয়েছে ছাত্র-শিক্ষকরা।
মন্দির প্রহরায় নিয়োজিত জনপ্রিয় নাশিদ শিল্পী শেখ এনাম বলেন, আমরা অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের স্বপ্ন দেখি। সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকবো এটাই আমাদের চাওয়া।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা রুহুল আমিন রুবেল জানান, উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। আর তাদের মন্দিরগুলোও নিরাপদ রয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রয়েছে।
জাবেদুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গল সম্প্রীতির শহর। শ্রীমঙ্গলে সংখ্যালঘুদের কারো ওপর হামলা হয়নি। মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেনি। দেখা গেছে সংখ্যালঘুদের মন্দিরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। আমি শহরের কালী মন্দিরে গিয়ে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মন্দির প্রহরায় দেখেছি।
বরুণা মাদরাসার শিক্ষক সৈয়দ আতহার জাকওয়ান বলেন, এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান আমরা সবাই মানুষ। কোনো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বা হয়রানির শিকার হোক আমরা তা চাই না। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে কোনো দুর্বৃত্তরা ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য আমরা ছাত্রদের নিয়ে পাহারায় রয়েছি।
এছাড়া বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের উদ্যোগেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাহারা চলমান রয়েছে। এদিকে রাতের বেলা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর টহল টিমও কাজ করছে। রাতে সেনাবাহিনীর গাড়ি শহরের বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সার্বজনীন দুর্গাবাড়ীর যুগ্ম সম্পাদক দেবাষীশ সেন গৌতম বলেন, আমাদের মন্দিরে এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। রাত জেগে মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মন্দির পাহারা দেওয়ায় আমরা নিরাপদ বোধ করছি। এই সাথে এলাকায় ছেলেরাও রাত জেগে নিরাপত্তা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ শ্রীমঙ্গল উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি ডাক্তার সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, আমাদের উপজেলায় কোন মন্দিরে হামলা বা লুটপাট হয়নি। প্রতিটি মন্দিরে নিজস্ব পাহারার পাশাপাশি মুসলিম ধর্মাবলম্বী ভাইয়েরাসহ বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্ররা আমাদের মন্দির নিরাপত্তার জন্য রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন।
শ্রীমঙ্গল পৌরসভার প্যানেল মেয়র মীর এম এ সালাম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং মন্দির-গির্জা রক্ষায় পৌরসভার মেয়র মোঃ মহসিন মিয়ার নেতৃত্বে আমরা মাঠে তৎপর রয়েছি। পাশাপাশি বরুণাসহ মাদরাসাতুল কুরআন মাদরাসার ছাত্ররা ট্রাফিক ও মন্দির পাহারা দিচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা এবং মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করবে।
© Deshchitro 2024