
৭ ডিসেম্বর লাখাই উপজেলার ইতিহাসে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ৭ ডিসেম্বর লাখাই প্রথম স্বাধীন হয় জিরুন্ডার মাটিতে।
৭ডিসেম্বর ১৯৭১ লাখাই উপজেলা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের স্বাধীনতা ঘোষণার ডাক শুনে এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক অমানবিকভাবে বাঙালি নিধনের বর্বর হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দেশের ন্যায় হবিগঞ্জে ও আমাদের লাখাইয়ের সাধারণ জনগণ ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি বলে পরিচিত তৎকালীন লাখাই থানার সাহসী ব্যক্তিত্ব, সাবেক এম এন এ ও হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে সভাপতি ও গভর্নর জনাব অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে প্রতিরোধ। তার নেতৃত্বে লাখাই এবং হবিগঞ্জের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে তখনকার সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গমন করে।
সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশে এসে বিশেষ করে তৎকালীন লাখাই থানার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। আমাদের এলাকার তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল বদর ও পাকিস্তানি দালালরা মুক্তিযোদ্ধাও স্বাধীনতা স্বপক্ষের মানুষদেরকে দমন করার সর্বপ্রকার চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লাখাইর সাবেক টিটি এন্ড ডিসিতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
লাখাইয়ের যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইলিয়াস কামাল নেতৃত্বাধীন দলটি লাখাইয়ের পূর্বাঞ্চলের বুল্লাবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে।
আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মাধবপুর থানার সুরমা সাহেব বাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তার দলটি লাখাইয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জিরুন্ডা গ্রামে অবস্থান নেয়। তাদের ক্যাম্প ছিল এই গ্রামের মরহুম জনাব আব্দুল হাইর রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলা ঘরে। তারা নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশন দখল করার কৌশল করতে থাকে।
এর মধ্যেই লাখাই থানা থেকে সংবাদ আসে পুলিশ ও রাজাকাররা যুদ্ধে জড়াবে না ও আত্মসমর্পণ করবে। পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত। এই কথা শুনে শফিকুর রহমান চৌধুরী বীরমুক্তিযোদ্ধা আহাদ কে প্রেরণ করে জিরুন্ডা মাঠে এসে আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশনা পাঠায় এবং উভয় পক্ষের আলোচনার পর দিনক্ষণ ঠিক করা হয় ৭ ডিসেম্বর।
পূর্ব নির্ধারিত তারিখ ও ঘোষণামতে লাখাই থানা পুলিশ ও থানায় অবস্থিত রাজাকার, আল বদর বাহিনী ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০ ঘটিকার সময় জিরুন্ডা উত্তরে ঐতিহাসিক খেলার মাঠে আসে এবং সকলের অস্ত্র মাটিতে রেখে আল্লাহর নামে শপথ করে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। অপরদিকে শফিক চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র থাক করে যুদ্ধের অবস্থান নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। অনেকক্ষণ পর শফিক চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লালসালু ভাই এবং সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী আত্মসমর্পণকারী পুলিশ ও রাজাকারদের ঘিরে ফেলে। সকল অস্ত্র তাদের কব্জায় নিয়ে আসে। এ সময় শফিক চৌধুরী জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে জিরুন্ডার মাঠেই রক্তে রাঙানো বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করে। সকল রাজাকারদের হাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে তাদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে তখনকার লাখাই থানায় প্রবেশ করে।
অপরদিকে এই সংবাদ পেয়ে বুল্লা বাজারে ইলিয়াস কামাল এর মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্পেও একই দিনে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিন সারা থানায় জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়। সাধারণ জনগণের মুখেও জয় বাংলা স্লোগান উঠে এবং আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয।
জিরুন্ডার মাটিতে ই লাখাই থানার প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয় এবং লাখাই থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।