|
Date: 2022-11-26 18:29:13 |
◾মামুন রশীদ
শিশুদের বেড়ে ওঠা তাদের চিন্তার জগতের বিস্তৃতি কি কমছে? শিশুর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার শৈশব? একসময় টেলিভিশন নামের বোকাবাক্সকে দেখা হয়েছে শিশুর বেড়ে ওঠার অন্তরায় হিসেবে। আজ হারিয়ে যেতে বসেছে বোকাবাক্স। তার স্থান দখল করে নিয়েছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস আর নানা রকম গ্যাজেট। খেলার মাঠ থেকে শিশুর জগৎ এখন স্থির হয়েছে দুহাতের মুঠোয় ধরে রাখা ডিভাইসে। ফুটবল মাঠের বল গড়ায় এখন শিশুর হাতের ছোঁয়ায় ডিভাইসের পর্দায়। বইয়ের জগৎ থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছে শিশুদের আগ্রহ। রূপকথার গল্প শুনে কল্পনার পাখা বিস্তার করতে শেখা শিশুর জগৎ এখন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের কাছে বন্দি। শিশুদের এই জগতের পাশাপাশি পুরোনো, হারিয়ে যাওয়া রূপকথার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন আলী ইমাম (৩১ ডিসেম্বর ১৯৫০-২১ নভেম্বর ২০২২)। শিশুর সারল্যে, শিশুদের জগতের নির্মাতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম এই লেখকের শৈশব-কৈশোর কেটেছে পুরান ঢাকার ওয়ারী, লিঙ্কন রোড, নয়াবাজার, নওয়াবপুর, কাপ্তানবাজার, ফুলবাড়িয়ায় এলাকায়। পরবর্তী সময়ে থেকেছেন পুরান ঢাকার ঠাটারিবাজারে। তার সাহিত্যচর্চার শুরু কিশোর বয়সেই। ১৯৬৮ সালেই তিনি চ্যাম্পিয়ন হন পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষা সপ্তাহে বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতায়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান শুরুতে, সেই উত্তাল দিনগুলোতেই তিনি শিশুদের জন্য নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। আমৃত্যু তিনি লিখছেন মূলত শিশু-কিশোরদের জন্যই। সে সময়ে তিনি নিয়মিত যেতেন কচি-কাঁচার আসরের দাদাভাইয়ের কাছে। উদ্দেশ্য নিজের লেখা দেওয়া। এ সময় থেকেই তার প্রচুর লেখালেখির শুরু। শিশুসাহিত্যে সে সময়ে তার সঙ্গী ছিলেন শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুন। শিশুসাহিত্যে সে সময়ের এই ত্রয়ী লেখকের মাঝে অন্য দুজন নিজেদের লেখার জগৎ বদলালেও আলী ইমাম পথ পাল্টাননি। তিনি শিশুদের জন্য লেখাকেই ব্রত হিসেবে নেন।
আলী ইমামকে ছেলেবেলায় অনুপ্রাণিত করেছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বই ‘বুড়ো আংলা’। এটি তাকে টেনে এনেছে লেখার ভুবনে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বইটির প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি তো লেখালেখির জগতে আসলাম একটা বই পড়ে। সেটা হলো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’। বইটা আমি পড়ি ১৯৬৪ সালে, তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বইটি আমাকে স্কুল লাইব্রেরিতে পড়তে দিলেন বাংলা শিক্ষক কাজী নুরুল হক। বইটি পড়েই বুঝলাম, সাহিত্য, ভাষা, শব্দ যা এমন একটা জিনিস যা মানুষকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যা মানুষকে পাল্টে দেবে। আমারও চারপাশটা পাল্টে গেল। আমি বুঝতেই পারিনি লেখার ভেতরে, শব্দের ভেতরে একটা জাদুকরী প্রভাব থাকতে পারে। এরপর থেকে বুঝতে পারলাম আমাকে শব্দের সঙ্গে থাকতে হবে এবং আমি লেখালেখি শুরু করলাম।’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় আলী ইমামের প্রথম বই। ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’ নামের বইটির প্রকাশক ছিল বর্ণমিছিল। প্রথম বইয়েই তিনি আশীর্বাদ পান কবি শামসুর রাহমানের। বইয়ের ব্লার্ব লেখেন কবি শামসুর রাহমান। আলী ইমাম লিখেছেন প্রচুর। ঈর্ষণীয় তার বইয়ের সংখ্যা। এক জীবনে প্রায় ছয় শতাধিক বইয়ের রচয়িতা, লেখার পেছনে জীবনের কতটা সময় দিয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়। তবে শুধু লেখার জগতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না তিনি। শুধু লেখালেখি বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাণের মাঝেই তিনি নিজেকে ধরে রাখেননি। তিনি যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও। শিশুর বিকাশের জন্য, তাদের মনোজগতের পরিবর্তনের জন্য তিনি কাজ করেছেন কচিকাঁচার মেলা, চাঁদের হাট, শিশুসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা নগর জাদুঘর, গণহত্যা জাদুঘরসহ নানান সংগঠনের সঙ্গে। ‘মন্তাজ’ নামে একটি সিনে ক্লাবও তৈরি করেছিলেন, যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গেও। আবার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে অসংখ্য অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন। তার দ্বিতীয় বই ‘অপারেশন কাঁকনপুর’। ছোটদের জন্য এই লেখাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৮ সালের কিশোরবাংলা পত্রিকার ঈদসংখ্যায়। যা পরের বছর বই হয়ে প্রকাশ পায়। উপন্যাসটি অবলম্বনে নাটক নির্মাণ করে প্রচার হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ এবং নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
আলী ইমাম বিশ^াস করতেন, ‘বই স্বপ্ন দেখাতে শেখায়’। তাই তিনি বরাবরই সচেষ্ট থেকেছেন তেমন ধরনের বই রচনার দিকে। যে বই শিশুকে স্বপ্ন দেখাবে, যে বই শিশুকে ভাবতে শেখাবে। তাদের কল্পনার জগতে পাখা মেলতে শেখাবে। আর এ ধরনের বইয়ের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছেন। ভেবেছেন শিশুকে প্রেরণা জোগানো, তাকে উদ্দীপ্ত করে তোলার মতো বই প্র্রয়োজন। সেই প্রয়োজন মেটানোর দায় তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। তাই তার রচনাতেও আমরা দেখা পাই বিচিত্র বিষয়ের। সাগরতলের রহস্য থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞান, প্রাচীন উপকথা, লোককথা, রূপকথার সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও তিনি শিশুদের উপযোগী করে লেখায় তুলে এনেছেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে তিনি শিক্ষক ভাবতেন। তাই আলী ইমাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি টাইম মেশিনে চড়ে প্রাচীন গ্রিসে যেতে চান। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ সেলফি। কিন্তু এক সময় ডেলফি নামের একটা মন্দির ছিল, যার দরজায় লেখা ছিল, নো দাইসেলফ। নিজেকে জানো। এই যে জ্ঞান আসল তা সেই সময় থেকেই এসেছে। জ্ঞানের যে বিভাজন, তা সেই সময় থেকেই শুরু। তাই আমি সেই সময়ে সক্রেটিসের একজন ছাত্র হতে চাইব।’
তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য প্রামাণ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র প্রযোজক। অনুষ্ঠানটি টানা সাত বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়। এ ছাড়া তার উপস্থাপিত ‘হ্যালো, আপনাকে বলছি’ অনুষ্ঠানটিও বাংলাদেশ টেলিভিশনে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। তিনি ইউনিসেফের ‘মা ও শিশুর উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম প্রকল্প’ পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পালন করেছেন মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রি জুঁনেসি চিলড্রেনস টিভি প্রোডাকশন প্রতিযোগিতা’র (২০০০) জুরির দায়িত্বও। আলী ইমামের বিচরণ ছিল শিশুর মনোজগতে। শিশুর ভাষাকে তিনি রপ্ত করেছিলেন, আর সেই ভাষাকেই তিনি শিশুর সারল্যে ধরে রেখে তুলে এনেছেন বইয়ের পাতায়। ফলে শিশুদের মানসিকতার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তার আত্মিক জগৎ। তাই তার লেখায় উঠে এসেছে শিশু মনস্তত্ত্ব, তাদের কল্পনার জগৎ। তার রচনা সম্ভারের মতো এত বিপুল ঐশ্বর্য বাংলা ভাষায় আর কোনো লেখকের ভান্ডারে নেই। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে--সোনালী তোরণ; আলোয় ভুবন ভরা; দুঃসাহসী অভিযাত্রী; প্রিয়-প্রসঙ্গ; বুনোহাঁসের পালক; সেসুলয়েডের পাঁচালী; রক্ত দিয়ে কেনা; ভিনদেশী কিশোর গল্প; কাছের পাহাড় দূরের পর্বত; সাগর থেকে সাগরে; বাংলাদেশের কথা; বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশ; দূরের দ্বীপ কাছের দ্বীপ; প্রাচীন বাংলা বৌদ্ধ বিহার; বাঙলা নামে দেশ; ডানা মলার দিন; দেখোরে নয়ন মেলে; কাছে থেকে দূরে; ধলপহর; হিজল কাঠের নাও; ঘাসের ডগায় হলুদ ফড়িঙ; অপারেশন কাঁকনপুর; পাখিদের নিয়ে; জাফলঙ্গের বিভীষিকা; সবুজ বাড়ির কালো তিতির; বাদাবনে লড়াই; হিমছড়ির ভয়ঙ্কর; সনুমামার অভিযান; ভয়ঙ্করের হাতছানি; নীল সাগরের প্রাণী ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ পেয়েছেন ইকো সাহিত্য পুরস্কার, নেধুশাহ সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার। ৭৩ বছর বয়সে এই শিশুসাহিত্যিকের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের শিশুসাহিত্য চর্চার এক গৌরবময় অধ্যায়ের।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
© Deshchitro 2024