◾ সাকিবুল হাছান || প্রতি বছর দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিংয়ের অবস্থা দেখেই যাওয়ার কথা উচ্চশিক্ষায় বৈশ্বিক মানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থা কেমন। কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২৫ অনুযায়ী, এশিয়ার সেরা ১০০ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। এবারও র‍্যাঙ্কিংয়ে সবার ওপরে আছে চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি (বেইজিং)। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে প্রতিবছরই প্রশ্ন উঠে। আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বের হচ্ছে কিন্তু খুব কম সংখক শিক্ষার্থীই জব পাচ্ছে। কিন্তু কেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেও চাকরী পাচ্ছে না তা প্রশ্ন থেকেই যায়।


প্রারম্ভে আলোচনা করা যেতে পারে , আমাদের দেশে বৈশ্বিক মানের উচ্চশিক্ষা কেন প্রয়োজন সেইসঙ্গে বাংলাদেশ বৈশ্বিক মানের শিক্ষার জন্য করনীয় কি। বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষা আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেইসাথে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈশ্বিক মানের সাথে সঙ্গতি রাখে এবং তা খুবই প্রয়োজনীয়। আপনি যদি লক্ষ করেন তাহলে দেখতে পারবেন যে, বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা লাখ লাখ টাকা বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে লোকবল হায়ার করছে। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের দ্বারা কেন সম্ভব হচ্ছে না। নিজ দেশে এতো এতো বেকার থাকা স্বত্বেও কেন বিদেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে লোকবল হায়ার করতে হচ্ছে। এই দায়ভার কাদের? বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা কতটুকু তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ তা এখনই ভাবনার বিষয়।


বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়ন এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করবো যা বাংলাদেশকে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে। শিক্ষণ এবং পাঠদানের গুণগত মান উন্নয়নের দিকে সরকারের সুদৃষ্টি দিতে হবে। কারণ পাঠদানের পরিবেশ ভালো না হলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার আগ্রহ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেইসঙ্গে বৈশ্বিক মানের জন্য বাংলাদেশকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত ডিগ্রি এবং আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলনগুলোর সাথে শিক্ষকদেরকে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাছাড়া, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়নও প্রয়োজন, যাতে থাকবে বৈশ্বিক মানের গবেষণা কেন্দ্র এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এমন পরিবেশ। দেশের বিশেজ্ঞরা মনে করেন, গবেষণা বৈশ্বিক একাডেমিক মানের মূল ভিত্তি। দেশে গবেষণা ক্ষেত্রে বরাদ্দ অবশ্যই বাড়াতে হবে। উদ্ভাবনের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উচ্চ-প্রভাব গবেষণায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, কেবলমাত্র শিক্ষা মান উন্নয়ন নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সহায়ক হবে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। যেমন লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি যা উচ্চমানের শিক্ষা প্রদান করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।


আধুনিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন যাতে এমন একটি শেখার পরিবেশ তৈরি করা হয় যা বৈশ্বিক মানের উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশা পূরণ করে। এবং বাংলাদেশের বৈশ্বিক খ্যাতি সমৃদ্ধি করতে হলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে হবে। আর সেটার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে এবং সমতা নিশ্চিত করে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা সবার জন্য একটি অধিকার, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা। তবে আমাদের দেশে উপরমহল থেকে সাধারণ মানুষজন পর্যন্ত পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কে বড় চোখে দেখে। সাত কলেজ কিংবা ন্যাশেনাল বিশ্ববিদ্যালয় যেন তাদের দৃষ্টির বাহিরে৷ যদিও দেশের অর্থাৎ তথা লাখ লাখ শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করছে। তাই উচ্চ শিক্ষায় বৈশ্বিক মানের জন্য শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলিকে বৈশ্বিক মান পূরণের জন্য বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা সংস্থাগুলির সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপন করতে হবে। বৈশ্বিক মানের ট্রেইনার কর্তৃক বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাথে যৌথ গবেষণা প্রকল্প এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারবেন, যা একাডেমিক মান উন্নত করতে সাহায্য করবে।


বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-শিক্ষায় সহযোগিতা করতে হবে সেইসঙ্গে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় নজর না দিয়ে শিল্পের সাথেও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার মাধ্যমে স্থান দখল করে নিতে পারে। যা আমাদের একাডেমিক শিক্ষা এবং বাস্তব কাজের প্রয়োগে সংযোগ স্থাপন করবে ফলে নিশ্চিত করবে যে শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিকভাবে চাকরির উপযোগী। বৈশ্বিক উচ্চ শিক্ষা মানের প্রধান উপাদান হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার পরিবেশ তৈরি করা, বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা সেইসঙ্গে আমাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বিকাশের পথ দেখিয়ে দিতে হবে। আমার মনে বাংলাদেশ এখনো পুঁথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ। তাই বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা মান কে বৈশ্বিক করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে একঘেয়ে মুখস্থ বিদ্যা কিংবা সনাতন পদ্ধতি থেকে বের হয়ে ইন্টারঅ্যাকটিভ বা অনুসন্ধান ভিত্তিক শিক্ষায় পরিবর্তিত করতে হবে, যা তাদের সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধান এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷ আমাদের দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থা অর্থাৎ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন করবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মান পূরণের জন্য উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তাদের ডিগ্রি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মর্যাদা এবং স্বীকৃতি পায়। তাহলেই বাংলাদেশর উচ্চ শিক্ষার বৈশ্বিক মানের মতো হবে। বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষার জন্য অবশ্যই সরকারি সহায়তা প্রয়োজন এবং শিক্ষার নীতির সংস্কারও প্রয়োজন যা উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের শিক্ষা খাতে আরো বরাদ্দ দিতে হবে , স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করতে এবং এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বৈশ্বিক সেরা অনুশীলন গ্রহণে উৎসাহিত করে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন পদ্ধতিতে নজর না দিয়ে বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য উপরের উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো নিয়ে সরকার ভাবতে পারে যাতে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নায়ন হবে সেইসঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে বলে মনে করি। আর বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এই কথাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সেইসঙ্গে সাত কলেজ, ন্যাশেনাল বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কে বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষার বিকল্প নাই। কারণ শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গেলে, এগিয়ে যাবে আমাদের বাংলাদেশ।


লেখক  :   সাকিবুল হাছান

কলামিস্ট ও সংগঠক 

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024