ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার বর্তমান অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বিশ্বমানবতা যেন আজ নিশ্চুপ। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি পরিকল্পনা পেশ করে যেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দু'টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই পরিকল্পনা মেনে নেয়নি। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু। এই যুদ্ধকে আল-নাকবা বা "দুর্ভোগ" বলা হয়, এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বড় ক্ষতি ছিল, কারণ অনেক ফিলিস্তিনি তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে শরণার্থী হয়ে পড়ে।
যুদ্ধের পর ইসরায়েল বিজয়ী হয় এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজেদের অনেক ভূমি হারিয়ে ফেলে। সেই থেকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের দের উপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে। ২০২১ সালে শেষ বড় আকারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ ২০২১ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার রকেট হামলা এবং বিমান আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে গাজার অনেক মানুষ নিহত ও আহত হন, এবং ইসরায়েলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১১ দিনের সংঘর্ষের পর, জাতিসংঘ ও মিশরের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। তবে ইসরায়েলে আবারো বর্বরোচিত হামলা শুরু করে।
বছর শুরু হয়ে আবার বছর শেষ হয় তবে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার শেষ হয় না। কবে বন্ধ হবে এই বর্বরোচিত হামলা? কবে ফিলিস্তিন পাবে তাদের নিজস্ব ভূমি। আর কত মানুষের প্রাণ গেলে বিশ্ববাসীর ঘুম ভাঙ্গবে। সবকিছু মিলে ২০২৪ সাল ফিলিস্তিনের দুঃখ দুর্দশার বছর বলা যায়। আজ বিশ্ব মানবতা নিরব কেন? ২০২৪ সাল জোরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘর্ষ আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধ, দখলদারিত্ব, এবং মানবিক সংকট গাজার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে।
যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসব্যাপী অভিযানে গাজায় এ পর্যন্ত ৪৫,১২৯ জন নিহত এবং ১,০৭,৩৩৮ জন আহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে গাজার জনসংখ্যা প্রায় ৬ শতাংশ কমে গেছে। এমনকি, ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত, গাজায় ৫০০-রও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে দেখতে পাই কত কষ্টে ফিলিস্তিনরা জীবনযাপন করছে। গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাতে এবং তীব্র শীতে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে গাজায় শীতজনিত কারণে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ছয়জনই শিশু। তীব্র শীতের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক। গাজার শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঠান্ডা, বৃষ্টি এবং খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির সংকটের কারণে শিশুদের জীবন ঝুঁকির মুখে রয়েছে। গাজার সাধারণ মানুষের জন্য বিগত বছরগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ বছর। বোমা হামলা ও সংঘর্ষে হাজারো মানুষের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নিজ দেশে গৃহহীনতা, বেকারত্ব, এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের জীবনে অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে এসেছে।
বর্তমানে গাজা অবরোধের ফলে জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবার তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কিংবা সংস্থা থেকে সহায়তা নিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলের হামলার স্বীকার হয়েছে যা মানবতা বিরোধী।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সূত্রে জানা যায় ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংঘাত থামানোর জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তবে তা কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
যুদ্ধ ও দুঃখ দুর্দশার বিগত বছরগুলোর পরে ২০২৫ সালে গাজার মানুষে রা শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা করে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ ও সমঝোতা খুবই প্রয়োজন। একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে পারে কেন ফিলিস্তিন ইসরায়েল যুদ্ধের সমাপ্তি হচ্ছে না। চলুন কারণগুলো জেনে নেওয়া যাক। ফিলিস্তিন ইসরায়েলের সংঘাতের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত স্বার্থ এবং জোট রয়েছে যারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মতাদর্শ রয়েছে, যা ফিলিস্তিন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। এটা স্পষ্ট যে কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে চায় যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সমর্থনকে প্রভাবিত করেছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যুদ্ধ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ তাদের অবস্থান নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই ইসরায়েলের সমর্থক, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন প্রদানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। মোটাদাগে এই কারণে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া নীরব।
কিছু ইউরোপীয় দেশ আছে যারা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, সামগ্রিকভাবে ইউরোপ ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ফলে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে
জাতিসংঘ ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করেছে।
আমরা আর ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত দেহ দেখতে চাই। আমরা চাই শীগ্রই ফিলিস্তিন তাদের নিজস্ব ভূমি ফিরে পাবে। যেহেতু ফিলিস্তিন সংকট একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যার সমাধানে বিশ্ববাসীর কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। নিচে কিছু পদক্ষেপ উল্লেখ করা হচ্ছে।
যেহেতু ফিলিস্তিনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ তাই বিশ্বস্ত সংস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে অর্থাৎ বেঁচে থাকার আসবাবপত্র জোগাবে। আমরা আরেকটি কাজ করতে পারি তা হচ্ছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকট সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচার করা, যাতে বিশ্ববাসী এই বিষয়ে অবগত হয় এবং সমাধানের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।
অনেক প্রতিষ্ঠান বা দেশ ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়তা করছে, তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং তাদের পণ্য বয়কট করা। আমাদের দেশের সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা একান্ত প্রয়োজন যা আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। গাজা ও পশ্চিম তীরে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের মতো জরুরি সহায়তা প্রদান করা বিশেষ করে শীতবস্ত্র বিতরণ করা।
এই যুদ্ধ বন্ধে আমরা মুসলমান হিসেবে ইসরায়েলি পণ্য ও সেবা বর্জন করে পারি যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে পারে।
সেইসঙ্গে মুসলিম হিসেবে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এটি তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন ও সহমর্মিতা প্রকাশ করবে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষকেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলতে যেভাবেই হোক বাধ্য করতে হবে বিশেষ করে ইসরায়েল কে সেইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তা নিতে হবে। আমরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রচার করা।
ফিলিস্তিন সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনে বিশ্ববাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা। বিশ্ব মানবিক সহায়তা প্রদান করা। যেহেতু ইসরায়েল বিশ্ব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সর্বোচ্চ সোচ্চার হতে হবে। সাধারণ মানুষের উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনের সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। ২০২৫ সাল হোক ফিলিস্তিন তাদের নিজস্ব ভূমি ফিরে পাওয়া অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বছর।
লেখক :সাকিবুল হাছান
কলামিস্ট ও সংগঠক
Sakibulhasanlearning@gmail.com