ধর্ষণ এমন এক নৃশংস অপরাধ, যা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষয়ক্ষতি বহন করে। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এক ভুল ধারণা রয়ে গেছে – নারীর পোশাক অপরাধকে আহ্বান করে। তবে, তথ্য, পরিসংখ্যান ও সাম্প্রতিক ঘটনার গভীরে নজর করলে স্পষ্ট হয় যে, ধর্ষণের আসল অপরাধী হলেন অপরাধীর অভ্যন্তরীণ বিকৃতি, প্রশাসনিক অবহেলা ও পুলিশের ও বিচার ব্যবস্থার শিথিলতা। যারা এই দুর্বলতাগুলো তৈরি করে অবহেলা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ ও শাস্তি অপরিহার্য।


সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার প্রভাব

অনেকেই এখনও বিশ্বাস করেন যে, নারীদের পোশাক বা ফ্যাশন পছন্দ অপরাধকে আহ্বান জানায়। এই যুক্তি আসলে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর একটি নিদর্শন । যদি পোশাকই অপরাধের মূল কারণ হত, তাহলে কিভাবে ৮ বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হতে পারতো?
এমন যুক্তি সমাজের পক্ষপাতিতার প্রতিফলন করে, যেখানে অপরাধীর মানসিক বিকৃতি, সামাজিক অসচেতনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা উপেক্ষিত হয়ে যায়। যারা এই ভুল ধারণা পোষণ করেন, তারা শুধু নিজেদের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় করে না, বরং অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব থেকেও অবহেলা করেন। যারা অবহেলার মাধ্যমে এই অপরাধকে প্রশ্রয় দেন, তাদের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বোচ্চ নিন্দা করা উচিত ।

 

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও ঘটনার চিত্র

২০২৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আনুমানিক ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ‑পরবর্তী হত্যার ঘটনা ৩৪টি এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনা ৭টি রিপোর্ট করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুসারে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫২৩ জন নারী – যার মধ্যে ২৭৮ জন মারা যান এবং ১৭৪ জন আত্মহত্যা করেন। এছাড়াও, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অক্টোবর ২০২৪ প্রতিবেদন অনুযায়ী, একই সময়কালে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা আরও ব্যাপকভাবে ঘটেছে (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন)।

মাগুরার এক গ্রামে ৮ বছরের শিশুর ধর্ষণের ঘটনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের ওপর হেনস্তার ঘটনা এবং নানা অঞ্চলে নারীদের প্রতি অনেকে যেসব নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে – এ সবই আমাদের সমাজের গভীর নৈতিক পতন ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রমাণ। এই পরিসংখ্যান ও ঘটনার চিত্র স্পষ্ট করে যে, শুধু অপরাধীর ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, বরং পুলিশের অবহেলা ও বিচার ব্যবস্থার শিথিলতাও অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে ।

পুলিশের অবহেলা ও বিচার ব্যবস্থার শিথিলতা

বর্তমান পরিস্থিতিতে, ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় পুলিশের অবহেলা স্পষ্ট। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ধর্ষণ মামলাগুলোর প্রায় ৫০-৬০% ক্ষেত্রে পুলিশী তদন্তে দেরি বা অসতর্কতা দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের অবহেলার কারণে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়নি এবং শ্লীলতাহানির ঘটনার ক্ষেত্রেও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি ।

এছাড়া, টাঙ্গাইলে বাস ডাকাতির মামলায় সীমানাগত জটিলতা ও থানার মধ্যে দায়িত্ব এড়ানোর কারণে মামলা দায়েরে বিলম্ব হয়েছে (দৈনিক ইনকিলাব)। এসব ক্ষেত্রে, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবহেলার জন্য জনগণের আস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যারা এ ধরনের অবহেলা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ও জনসম্মুখে নিন্দা করা উচিত।

একাধিক প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ধর্ষণ মামলায় মাত্র ২০% ক্ষেত্রে অপরাধীদের কার্যকর শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এই দুর্বলতা শুধু বিচার ব্যবস্থার শিথিলতা নয়, বরং প্রশাসনিক অবহেলারও পরিচায়ক, যা অপরাধীদেরকে দণ্ড থেকে রেহাই দেয় এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচারের আশা নষ্ট করে (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন)।

নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কারের আহ্বান

বর্তমান আইন, যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে, আইন থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও বিচার ব্যবস্থার শিথিলতা স্পষ্ট।

নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হচ্ছে:

দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা:
ধর্ষণ মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত, যাতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুত হয় এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেতে পারেন ।


ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও সহায়তা:
ভুক্তভোগীদের পরিচয় গোপন রাখা, মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ক্ষতিপূরণ ও আইনি সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এসব পদক্ষেপ শিকারদের পুনরায় আত্মবিশ্বাস প্রদান করবে ।


পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার:
পুলিশের তদন্তে স্বচ্ছতা ও সময়ানুগ পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কঠোর নজরদারি প্রবর্তন করা আবশ্যক। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার উপর জোর দেওয়া উচিত ।

অপরাধীদের মানসিক পুনর্বাসন ও সচেতনতা বৃদ্ধি:
অপরাধীদের মানসিক ও আচরণগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সিভিল সোসাইটি মিলে ব্যাপক সচেতনতা প্রচারণা চালিয়ে সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও সমানাধিকারের ধারণা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন

প্রশাসনিক অবহেলা ও পুলিশের দায়িত্বের লঙ্ঘন – চরম নিন্দা

প্রতিবেদনগুলো স্পষ্ট করে দেখায় যে, পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা ও প্রশাসনিক শিথিলতা ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যারা এই অবহেলার মাধ্যমে শিকারদের উপর ভিক্টিম ব্লেমিং চালাচ্ছেন, তারা সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি এক বিশাল অবমাননা করছে।

এমন অবহেলা এবং দেরিতে মামলা গ্রহণ ও সঠিক তদন্ত না করার ফলে অপরাধীরা নিজেদের ওপর দায়বদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছেন এবং সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। যারা এ ধরনের অবহেলা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে জনসম্মুখে কড়া সমালোচনা ও কঠোর শাস্তির দাবি উঠছে (দৈনিক ইনকিলাব)।

উদাহরণস্বরূপ, টাঙ্গাইলে বাস ডাকাতির মামলার ক্ষেত্রে থানার অবহেলার জন্য অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় জনগণ। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর এই ঘটনার পরও, অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব ও সীমানাগত জটিলতার কারণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । এ ধরনের ঘটনার জন্য, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনসম্মুখে কঠোর শাস্তি ও সমালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।

সর্বশেষে, যারা নারীর পোশাককে অপরাধের কারণ হিসেবে তুলে ধরেন, তাদেরকে সমাজের অবহেলিত দিক, অপরাধীদের মানসিক বিকৃতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতি অন্ধভাবে সহায়তা করার অভিযোগে কড়া করে নিন্দা করা হচ্ছে। যদি পোশাকই অপরাধের মূল কারণ হত, তাহলে কিভাবে ৮ বছরের শিশুর ধর্ষণ ঘটতে পারতো – এই প্রশ্নটি স্পষ্টভাবে উত্থাপন করে যে, সামাজিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা অপরাধের মূল চালিকা শক্তি ।

প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যানের উল্লেখ

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অক্টোবর ২০২৪ প্রতিবেদন (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন) অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা ২২টি, যৌন নির্যাতনের ঘটনা ১৪টি ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ৪৩টি রিপোর্ট করা হয়েছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে দেখায় যে, অপরাধ রোধে শুধু আইনের বিধান নয়, বরং তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পুলিশের তদন্ত ও মামলা গ্রহণে ব্যাপক বিলম্ব ঘটছে, যা অপরাধীদেরকে শাস্তি থেকে বাঁচতে সহায়তা করে। 


এক নতুন ও কঠোর প্রতিরোধের আহ্বান

এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ধর্ষণ শুধুমাত্র অপরাধীর ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, বরং প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও শিথিলতার ফলাফল। যারা এই অবহেলা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ও জনসম্মুখে নিন্দা করা আবশ্যক।

আমাদের সমাজে যদি সত্যিকার অর্থে নারী, শিশু ও সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে প্রশাসনিক সংস্কার, দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও ব্যাপক জনসচেতনতা অপরিহার্য। যারা অবহেলার মাধ্যমে অপরাধকে প্রশ্রয় দেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরণের ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয় (দৈনিক ইনকিলাব, বিডিনিউজ২৪)।

এটি কেবলমাত্র একটি প্রতিবেদন নয়, বরং একটি সতর্কবাণী – সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যারা অবহেলার মাধ্যমে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেন, তাদেরকে কঠোরভাবে সমালোচনা ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। নারীর পোশাককে অপরাধের কারণ হিসেবে তুলে ধরলে, এই অবহেলা কতটা মানবিকতার অবমাননা তা আমাদের স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।

সর্বশেষে, আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, যে সকল প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলির তরফ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত – যেন ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় এবং সমাজে একটি সুরক্ষিত, সম্মানজনক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা যায় 

উৎসসমূহ:(দৈনিক ইনকিলাব), (জাতীয় মানবাধিকার কমিশন)



প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024