ধর্ষণ সমাজ জীবনে এক জঘন্যতম পাপাচার। জিনা-ব্যভিচার সমাজের এক বিধ্বংসী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ব্যভিচারের প্রসারের কারণে মানবতা আজ বিপন্ন হয়। খুবই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে একেরপর এক ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে যা দেশে নারীর সামাজিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাহলে আমরা কোন পথে হাঁটছি ! আমাদের সমাজব্যবস্থা কি ভেঙে পড়ছে? ধীরে ধীরে কি আমরা নিষ্ঠুর ও বিবেকহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি? এ প্রশ্ন এখন দেশের সকল বিবেকবান মানুষের। সারা দেশে একের পর এক ভয়াবহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশু, গৃহবধু, বয়োবৃদ্ধ কেউই। গোটা দেশের মানুষ এখন চরম আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ। ন্যায় বিচারের জন্য সবাই ফুঁসে উঠেছে। গতকাল মধ্য রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দর্শকের বিচারের দাবিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সবাই বলছে,বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। সন্দেহ নেই আলোচিত সমস্যাটি জঘন্যতম সামাজিক ব্যধি। একটি সমাজে এ ধরনের বিষয়গুলো যখন ব্যাপক হয়ে যায় তখন মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে এ ধরনের অপরাধ ব্যাপকতা পাবে, এটা চিন্তা করাই অনেক কষ্টের ব্যাপার। এ ধরনের  জঘন্য অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং এ ধরনের অপরাধ যেন বারবার না ঘটে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এধরনের জঘন্য অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর প্রথমেই অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা। তারপর অপরাধ বন্ধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু প্রতিকারের বিতর্কে যদি দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করা হয় তাহলে সে সুযোগে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয় এবং সাথে সাথে বিচারহীনতা বা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধ মহামারিতে রূপ নেওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়। যা আমরা বর্তমানে আমাদের দেশে দেখতে পারছি। আলোচিত দর্শনের শাস্তির বিষয়ে আমাদের ইসলামে কি বলা আছে তা জেনে নেওয়া যাক। কোরআন এবং অনেক হাদিসে ধর্ষণের শাস্তির ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলাম বিষয়টির স্পর্শকাতরতা স্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ধর্ষকের শাস্তি এবং ধর্ষিতার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইসলাম বলে, অপরাধী অবিবাহিত হলে তাকে একশ দোররা ও বিবাহিত হলে তাকে মৃত্যু দেয়া হবে। তবে ব্যভিচারের শাস্তি; যা পুরুষ-মহিলা উভয়কেই প্রদান করা হবে। কিন্তু যদি ব্যভিচার হয় বলপ্রয়োগপূর্বক তাহলে সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগকারী শাস্তি পাবে, যার উপর অত্যাচার করা হয়েছে সে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদকে ডাকে না, শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। আর যে ব্যক্তি এসকল কাজ করে সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে। এবং এ শাস্তি লাঞ্ছিত অবস্থায় সে অনন্তকাল ভোগ করতে থাকবে। (সুরা ফুরকান : ৬)। ধর্ষণ-ব্যভিচার এতোটাই জঘন্য যে, এর আশে পাশে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। ব্যভিচার ও ধর্ষণ রোধে ইসলামে পর্দার বিধান রাখা হয়েছে, নারীদের শালীন পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাথে দুনিয়া ও আখেরাতে এর কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। রাসূল সা. বলেন, ‘ব্যভিচারী অবিবাহিত নারী পুরুষকে ১০০ বেত্রাঘাত এবং ১ বছরের জন্য নির্বাসন করতে হবে। আর বিবাহিত নারী-পুরুষকে রজম করতে হবে অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে’ ( মুসলিম : ১৬৯০)। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, অর্ধ রজনীতে আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। এ সময় মুসলিম যে দুআই করবে তার সে দুআ আল্লাহ কবুল করবেন। তবে ব্যভিচারকে পেশা হিসেবে গ্রহণকারিণী নারীর দুআ আল্লাহ কবুল করবেন না। (আল মুজামুল কাবীর লিততাবারানী : ৪৩৯১)। এক হাদিসে আছে, রাসুল (সা.)-এর যুগে এক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুল (সা.) ওই নারীকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের শাস্তি দেন।(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৫৯৮) অন্য হাদিসে আছে, ‘গনিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে সরকারি নিয়ন্ত্রণাাধীন এক দাস জোরপূর্বক ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে যায়। উমর (রা.) ওই গোলামকে বেত্রাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে (অপকর্মে) সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কোনো ধরনের বেত্রাঘাত করেননি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৯৪৯) এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ইসলামের বিধান অনুযায়ী ধর্ষিতার করণীয় কী? ইসলাম বলে, কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে তার সর্বপ্রথম করণীয় হলো, সম্ভব হলে তা প্রতিরোধ করা। এমনকি যদিও তা ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতেও ইসলাম সায় দিয়েছে। সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২, তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১) ইসলামি আইনবিদরা একমত হয়েছেন যে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫) বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে, প্রথমে ধর্ষক ব্যভিচারের শাস্তি পাওয়ার হত্যার শাস্তি পাবে। যদি অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়, তাহলে ‘কিসাস’ বা মৃত্যুদণ্ড। আর যদি এমন কিছু দিয়ে হয়, সাধারণত যা দিয়ে হত্যা করা যায় না; তাহলে অর্থদণ্ড। যার পরিমাণ একশ উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ। সমাজে ধর্ষণের ঘটনা ঘটার কিছু কারণও রয়েছে। পরনারী কিংবা পরপুরুষের প্রতি কুদৃষ্টি দেওয়া। ইসলাম সেই উৎসটাই উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। তাই পুরুষকে নির্দেশ দিয়েছে দৃষ্টি অবনত রাখতে আর নারীকে বলেছে দৃষ্টি অবনত রাখার পাশাপাশি দৈহিক সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখতে এবং কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে শরিয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যেতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে নবী আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এটাই তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় পবিত্রতা। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা আবহিত আছেন। (সুরা নূর : ৩০)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের বাসস্থানে অবস্থান করবে এবং জাহেলি যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের মতো তোমরা তোমাদের প্রদর্শন করবে না, তোমরা যথাযথভাবে নামাজ আদায় করবে এবং জাকাত প্রদান করবে।’ (সূরা আহজাব : ৩৩)। সমাজের সবাই যদি ইসলামী আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এবং ইসলামিক আইন এবং রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়, তবে আশা করা যায় ধর্ষণের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে গণসচেতনা গড়ে তুলতে হবে। তবে এই সামাজিক অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে৷ সমাজ থেকে দূর হোক এই কলুষিত অধ্যায়। নারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। আর কোনো মা-বোনকে যেনো তাদের জঘন্যতম অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে না হয়৷ সাকিবুল হাছান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ, ঢাকা sakibulhasanlearning@gmail.com
প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024