◾দিলীপ ভৌমিক || বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর প্রশ্ন তুলছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।


সমাজের সকল স্তরের সচেতন মানুষের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এসব নির্মম ঘটনা। কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা অত্যন্ত শঙ্কিত, কী হতে যাচ্ছে এরপর?

মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ৮ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এই ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অবুঝ ভাইটির গালে স্পর্শ করে হয়তো আছিয়া বলেছিল, "আমি ফিরে আসব," কিন্তু ধর্ষকদের নির্মমতার কাছে তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা কি জানি, এর শেষ কোথায়?


গাজীপুরে মাগুরার ঘটনার পরপরই ৮ বছরের আরেক শিশুশিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়, যা আমাদের সমাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। সিরাজগঞ্জে গতকাল ২ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়েছে। চট্টগ্রামে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই এক এনজিও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এই ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবিতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।


সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছে অন্তত ৯,৬৭৭ শিশু, যার মধ্যে ৪,৮০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।


◾সামাজিক দায়বদ্ধতা

বিশেষ করে অনলাইন প্লাটফর্ম, গণমাধ্যম, স্কুল, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে আলোচনা ও কর্মসূচি আয়োজন করা উচিত। পরিবার, স্কুল এবং কমিউনিটিতে শিশুদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা শেখানোর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকা। নির্যাতনের শিকার শিশুদের সহায়তায় সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে নিকটস্থ প্রশাসন বা হেল্পলাইনে (যেমন: জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯) জানানো উচিত।



◾পরিবারিক দায়বদ্ধতা

শিশুরা যেন তাদের সমস্যা ও ভয় পরিবারের কাছে নির্ভয়ে বলতে পারে, সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বয়স অনুযায়ী শিশুদের ‘ভালো স্পর্শ-খারাপ স্পর্শ’ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দরকার। অপরিচিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যেমন-সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। শিশুর আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নির্দিষ্ট বয়সের শিশুকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। হাজারো কাজের ব্যস্ততা থাকলেও শিশুদের একা কোথাও যেতে না দেওয়া উচিত।

পরিশেষে, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ রোধ করতে সমাজের প্রতিটি মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। পরিবারকে হতে হবে সজাগ, সমাজকে হতে হবে দায়িত্বশীল, আর প্রশাসনকে হতে হবে কঠোর। কেবলমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা একটি নিরাপদ ও সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো।


লেখক: দিলীপ ভৌমিক

উন্নয়ন কর্মী

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024