|
Date: 2022-12-11 08:29:03 |
কাতার বিশ্বকাপে ৬ষ্ঠ বারের মতো ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে খেলছে মরক্কো। তবে বিশ্বকাপের মূল পর্বে আফ্রিকা থেকে সর্বোচ্চ ৮বার অংশগ্রহণ করে ক্যামেরুন, যারা ১৯৯০ সালে সর্বোচ্চ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল।
একই মহাদেশ থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছে নাইজেরিয়া ছয়বারের অংশগ্রহণে তিনবারই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত গিয়েছিল।
মরক্কো প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় ১৯৭০ সালে। আগের পাঁচটি আসরে তারা কেবলমাত্র ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। ওই আসরে তারা পোল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের সঙ্গে ০-০ গোলের ড্র করার পাশাপাশি পর্তুগালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় রাউন্ডে পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-০ ব্যাবধানে পরাজিত হতে হয়।
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ আসরে তারা কোন পয়েন্টই পায়নি। গ্রুপের তিনটি দলের কাছেই তারা ন্যূনতম এক গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তারা ৪ পয়েন্ট পেলেও দ্বীতীয় রাউন্ডে উঠতে পারেনি। নরওয়ের বিপক্ষের ম্যাচে আত্মঘাতী গোল এবং গোলরক্ষকের বেশ কয়েকবার ভুলের কারণে ২-২ গোলে ড্র করতে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয় তারা। ১৯৯৮ সালে তারা ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১০তম স্থানে ছিল। কিন্তু, সেই র্যাংকিনে এখন ২২তম স্থানে রয়েছে তারা।
আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস টুর্নামেন্টে মরক্কো মাত্র একবার শিরোপা জিততে সক্ষম হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। একই আসরে তারা রানার্সআপ হয়েছিল ২০০৪ সালে।
সিএএফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লীগে মরক্কোর ক্লাবগুলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাতবার শিরোপা জিতেছে।
সিএএফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লীগে মিশরের আল-আহলি ক্লাব মরক্কোর ওয়াইদাদ ক্লাবের কাছে হেরে যাবার পর, আল-আহলির দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ পিতসো মোসিমানে বলেছেন, মরক্কো দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে ফুটবলে ২০ বছর এগিয়ে গেছে। তিনি আরো জানান, উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ফুটবলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, রাজনীতি এবং ধর্মের পরে ফুটবল এখানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
বুরকিনা ফাসোর খেলোয়াড়, অ্যালাইন ট্রাওরে যিনি ৬৫ ম্যাচে ২১ গোল করেছেন, তিনি ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মরক্কোর ফুটবল খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের লীগ এই মুহূর্তে আফ্রিকান অঞ্চলের সেরা লীগ।’
২০১৪ সালে মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান হয়ে আসেন ফৌজি লেকইয়া। তিনি এসে মরক্কোর ফুটবলের উন্নয়নে তিনটি বিষয়ে প্রাধান্য দেন।
প্রথমে যে কাজটি করেন সেটা হল মরক্কোজুড়ে যে সমস্ত স্টেডিয়াম বা খেলার মাঠগুলো ছিল সেগুলোর সংস্কার বা নতুন করে তৈরি করা শুরু করেন এবং এর পাশাপাশি মাঠগুলোতে তিনি টার্ফের পরিবর্তে ন্যাচারাল ঘাসে খেলার উপরে জোড় দেন।
দ্বিতীয় যে কাজটি করেন সেটা হলো, সব ফুটবল ক্লাবগুলোকে ফেডারেশনের নজরদারিতে নিয়ে আসেন এবং প্রথম বিভাগে প্রতিনিধিত্ব করা সব ক্লাবগুলোকে বার্ষিক ৭ লাখ ডলার করে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফেডারেশন প্রতিটি ক্লাবের খেলোয়াড়রা সময়মতো বেতন পান কিনা এবং মাঠ ভালো অবস্থায় থাকে কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করে। শুধু তাই নয় জাতীয় লীগে ভালো করা দলগুলোকে তিনি বিশেষ বোনাস দিয়ে থাকেন। সেই সাথে আফ্রিকান ক্লাব কাপে অংশ নেয়া দল গুলোকে ভ্রমণ এবং বাসস্থানের জন্য ফেডারেশন থেকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।
তৃতীয় আরেকটি কাজ ফুটবল ফেডারেশন খুব সুন্দর ভাবে করে যাচ্ছে, সেটা হল তরুণদেরকে প্রফেশনাল ফুটবল দলে সুযোগ পাওয়ার আগে তাদের ঘষামাজা করার কাজটিও তদারকি করছে তারা।
আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস এবং ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে মিশরের জয় জয়াকার ভাঙার জন্য মরক্কো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই তরুণদের জন্য মরক্কোজুড়ে ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রয়েছে যার ব্যবস্থাপনা থেকে বর্তমান বিশ্বকাপ দলে উঠে এসেছেন ইউসুফ এন-নেসিরি, আজ্জেদিন ওনাহি, নায়েফ আগুয়ের্দের মত খেলোয়াড়, যারা স্পেন, ফ্রান্স এবং ইংলিশ লীগ মাতিয়েছেন। মরক্কোর সালেতে অবস্থিত মোহাম্মদ (ষষ্ঠ) ফুটবল ন্যাশনাল একাডেমিতে ২০১৮ সালে ৬৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়। যাকে আফ্রিকা ফুটবলের 'স্পোর্টস মক্কা' হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
এই ন্যাশনাল একাডেমিতে তারাই সুযোগ পাবেন, যারা বিভিন্ন রাজ্যের একাডেমিতে ভালো ফল করতে পারবে। বর্তমানে এই একাডেমিতে চালু কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করে পর্তুগাল ও ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার নুনো গোমেজ এবং মিকেল সিলভেস্ট্রে একে বিশ্বমানের বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ফুটবলকে পুরো মরক্কোতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন শহরে বড় বড় স্টেডিয়াম তৈরি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কাসাব্লাঙ্কা, রাবাত, আগদির, মারাকেশ, ফেজ, ট্যাঙ্গিয়ার প্রভৃতি শহরে ৬টি স্টেডিয়াম রয়েছে যাদের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৬৭ হাজারের মধ্যে। স্টেডিয়ামগুলো হলো স্টেড মোহাম্মদ ভি, স্টেড প্রিন্স মৌলে আবদেল্লাহ, আদর স্টেডিয়াম, গ্র্যান্ড স্টেড ডি মারাকেশ, ফেজ স্টেডিয়াম এবং স্তাদে ইবনে বতুতা।
এ ছাড়া, মরক্কো পর্তুগাল এবং স্পেনের সাথে যৌথভাবে ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যার অংশ হিসেবে ৯৩ হাজার এবং ৫৫ হাজার দর্শক আসন বিশিষ্ট দুটি নতুন স্টেডিয়াম, গ্র্যান্ড স্টেড ডি ক্যাসাব্লাঙ্কা ও গ্র্যান্ড স্টেড ডি ওজাদা নির্মীয়মান অবস্থায় রয়েছে। আর এসবই মরক্কোর ফুটবলে এক নতুন গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে।
ফিফাও মরক্কোর বিভিন্ন ফুটবল উন্নয়ন কার্যক্রমে বেশ খুশী। গত জুনে মরক্কোতে ফিফা আয়োজিত ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট স্কিম (টিডিএস) কর্মশালাতে ফিফা উল্লেখ করেছে, মরক্কো নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার, সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার এবং কার্যকরী ফরোয়ার্ড তৈরি করার জন্য বিশ্বব্যপী একটি ভালো মডেল হতে পারে।
২০১৮ বিশ্বকাপের সময় দলটিতে ২৩ জনের স্কোয়াডে ১৮ জন খেলোয়াড় ছিল, যারা ফ্রান্স, বেলজিয়াম বা জার্মানির মতো দেশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও মরক্কোর হয়ে খেলেছিল।
হার্ভে রেনার্ড তখন তাদের কোচ ছিলেন যিনি কিছুটা আক্রমণাত্মক খেলাতে পছন্দ করেন, যার উদাহরণ আমরা এবারের বিশ্বকাপে সৌদি আরবকে দেখছি।
রেনার্ডর নেতৃত্বে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে না যেতে পারলেও তারা লড়াই করেছিল সেয়ানে সেয়ানে। ইরানের সঙ্গে ১-০ গোলে পরাজিত হওয়া ম্যাচটিতে তারা গোল খেয়েছিল ৯৪ মিনিটের আত্মঘাতী গোলে। পর্তুগালের বিপক্ষের ম্যাচটিতেও তারা ০-১ গোলে হেরেছিল রোনালদোর দেওয়া গোলে। কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও সেই ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করেছিল মরোক্কানরা। আর স্পেনের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র হওয়া শেষ ম্যাচটিতে ৯০ মিনিট সময় পর্যন্ত এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ৯১ মিনিটে স্পেন সমতা আনলেও মাত্র ১ পয়েন্ট অর্জন করায় গ্রুপ পর্যায় থেকে বাদ পড়তে হয়।
© Deshchitro 2024