|
Date: 2025-03-18 14:32:13 |
◾ শামীম আহমেদ || মহাবিশ্বের বয়স বেড়েছে, এগিয়ে গিয়েছে বিশ্ব। শতাব্দীর পর শতাব্দীর গড়ে উঠেছে নতুন নতুন সভ্যতা। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া থেকে বর্তমান আধুনিক সভ্যতা সবটাই ভর দিয়ে আছে জ্ঞান বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নাটাই ইউরোপ- আমেরিকা হাতে। পরোক্ষভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছেও তারাই। আমরা বাঙালিরা তাদের মতো উন্নত জাতি হতে বদ্ধ মরিয়া, তাই পশ্চিমাদের মতো পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাসে অভ্যস্থ হওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্থ । কিন্তু আমাদের কে বুঝাবে শুধুমাত্র বেশভুসায় সাদৃশ্য থাকলেই উন্নত জাতি হওয়া যায় না। জরুরি বিষয় হলো জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রগতি অর্জন, দায়িত্বশীল হওয়া, রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়মনীতি যথোপযুক্ত ভাবে পালনসহ বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিয়োজিত থাকা । সে দিক দিয়ে আমরা হাজার গুণ পিছিয়ে।
একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। শিক্ষায় যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি ঠিক তত বেশি সমৃদ্ধ। বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা ছাড়া টিকে থাকা অনেকটা অসম্ভব এবং যদি থাকেও থাকতে হবে পরনির্ভর হয়ে। আমাদের দেশের শিক্ষার হার বাড়েছে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু মান সে হারে কতটুকু বেড়েছে সে কথা মুলতবি রাখলাম। দেশে স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনের তুলনায় কমবেশি যাই থাকুক না কেন কিন্তু কতটুকু মানসম্মত সেটা ভাবা দরকার। দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার পুরোটাই অন্তঃসারশূন্য । ঠিক সেখানে পশ্চিমারা শক্তিশালী এবং বিশ্বে প্রথম সারিতে। প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশে এ খাত যথেষ্ট দূর্বল। প্রাথমিকে ১১ বছর বয়সে বাংলাদেশের শিশুরা যা শিখে তা অন্য দেশের শিশুরা শিখছে সাড়ে ৬ বছরে। ফলে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তর শেষ করলেও তারা সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে। তৃতীয় শ্রেণীর শিশুদের বাংলা পাঠের অবস্থা খুবই করুণ। তাদের ৬৫ শতাংশ বাংলা পড়তে পারে না। তৃতীয় শ্রেণীর ৩৫ শতাংশ শিশু কোনো রকম বাংলা পড়তে পারে। ঠিক সেই সময়ে ইউরোপ - আমেরিকায় শিশুদের আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হচ্ছে এবং খেলাধূলার মাধ্যমে মানসিক বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ নিশ্চিত করা হচ্ছে। শিশুর চাহিদা আনুসারে পাঠক্রমে সাজানো হয়েছে। আমাদের দেশের মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুরোটাই গঁদ বাধা নিয়মে পড়াশোনা।
বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যথেষ্ট অনুপস্থিত, ব্যবহারিক শিক্ষা পুরোপুরি অবমূল্যায়ন এবং মুখস্থ নির্ভর হওয়াতে শিক্ষার মূল বিষয়েই ফাঁক রয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বে পড়াশোনা হচ্ছে সম্পুর্ন ব্যবহারিক পদ্ধতিতে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কৌশলভিত্তিক শিক্ষা (Project-Based Learning): শিক্ষার্থীরা প্রকল্প তৈরি করে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান শিখে। সমস্যাভিত্তিক শিক্ষা (Problem-Based Learning): শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য তৈরি করা হয়। বহুমুখী শিক্ষা: ভাষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিভিন্ন বিষয় শিখতে উৎসাহ দেয়া হয়।
উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য দেশে ৫৬ টি পাবলিক এবং ১১৩ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও খুব বেশি কাজে আসতে পারছে না। বাজেট বরাদ্দ কম থাকায় প্রয়োজনীয় গবেষনায় করা সম্ভব হয় না। ল্যাব, লাইব্রেরি, ক্লাসরুম, লোকবল সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ধুঁকছে। আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাবজেক্টের সংখ্যা অপ্রতুল । রাষ্ট্রের গবেষণায় তাগিদ কম। দেশে গবেষণালব্ধ সেক্টর কম থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা গবেষণা থেকে দূরে সরে গিয়ে সরকারি চাকুরীর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হচ্ছে । বাংলাদেশ সিভিল সার্ভস পরিক্ষার প্রস্তুুতির দিকে একটু নজর দিলে ভয়াবহতা বুঝা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাজনীতির একপ্রকার আড্ডা খানায় পরিনত হাওয়াতে পড়াশোনা ধস নেমেছে অনেক আগেই। শিক্ষার মানে পুরুত্ব কতটুকু আঁচ করা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল এবং পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প গুলোতে দেশের প্রকৌশলীদের গৌণ অংশগ্রহণ থেকে। আবার মেধার যথাযথা কদর না থাকায় মেধাবীর দেশের বাইরে পারি জমাচ্ছে।
অন্যদিকে কথায় কথায় ইউরোপ, আমেরিকার সাথে তুলনায় করি, তাদের সংস্কৃতি আমদানি করার করার জন্য মুখিয়ে থাকি, কথা বার্তায়, চাল চলনে, পোশাক পরিচ্ছদে এবং শিক্ষায় সর্ব উত্তম ভাবে অনুকরণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কতটুকু জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ হতে পেরেছি তার একটু নজর উদ্ভাবনীয় কাজের দিকে নজর দিলে স্পষ্ট হবে। সে দিকটা প্রায় শূন্যের কোঠায়। প্রমথ চৌধুরী এই জন্যই বলছিলেন যে জাতি জ্ঞানের বিচারে ভবানী, সে জাতি ধনের বিচারেও শূন্য। তার বাস্তব চিত্র আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সবটাই যখন পশ্চিম দেশগুলো তৈরি করছে তখন আমরা কাড়িকাড়ি আর্থ দিয়ে আমদানি কারছি । উন্নত বিশ্ব তৈরি করছে এবং আমরা দেদারসে ব্যবহার করছি। তারা যখন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে তখন আমরা ভিডিও গেমিং করছি। পশ্চিমদের সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদে ফাঁদে পা দিয়ে নিজের দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ধ্বংস করছি। যার ফলে সামাজের নিজস্ব ভারসাম্য হারিয়ে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে । পশ্চিম সংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে। সমাজে পরস্পরের মাঝে শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে।
শুধুমাত্র বাহ্যহিক দিক দিকে সাদৃশ্য থাকলে উন্নত জাতির সাথে তুলনা চলে না। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পাল্লা দিয়ে সমকক্ষ হতে হয়। চিন্তাচেতনায় মিল থাকতে হয়। বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা দরকার পড়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। তবেই সত্যিকার উন্নত জাতির মর্যাদা পাবে।
শামীম আহমেদ
লেখক ও সংগঠক
© Deshchitro 2024