আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস। মুসলমানদের জন্য আজকের দিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। রাসূলুল্লাহ (স.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ২য় বর্ষের ১৭ রমযান (৬২৪ খ্রিস্টাব্দে) মদিনার দক্ষিণ পশ্চিমে ৮০ মাইল দূরে বদর নামক উপত্যকায় মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে মুসলমানদের এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ছিল মুসলমানদের অস্তিত্বের লড়াই। এই যুদ্ধ ছিল সত্য ও মানবকল্যাণের পক্ষে। এই জন্য বদর যুদ্ধকে বলা হয় সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অত্যাধিক। বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর আদেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (স.) মদিনার সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে সেখানে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করেন। ইসলামের একটি উপযোগী পরিবেশ পাওয়ায় দলে দলে মদিনাবাসী ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে মদিনার মুসলনাগণ আরব বিশ্বে সুসংগঠিত ও নতুন শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হতে পারে। মুসলমানদের এই অগ্রগতি মক্কার ক্ষমতা লোভী কুরাইশদের বেশ চিন্তিত করে তুলে। তাই মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলীন করার অপচেষ্টায় ২য় হিজরির ১৭ রমযান (৬২৪ খ্রিস্টাব্দে) মক্কার কুরাইশরা মদিনায় আক্রমণ করে। মদিনা ও তার নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (স.) এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ১০০০ জন সৈন্যের বিপরীতে মুসলিম বীর ছিলেন মাত্র ৩১৩ জন। এর মধ্যে মুহাজির ৮২ জন, আনসারদের মধ্যে আওজ গোত্রের ৬১ জন ও খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন মুজাহিদ ছিলেন। যুদ্ধের সরঞ্জাম হিসেবে মাত্র ৭০টি উট ও ২টি ঘোড়া ছিল। অন্যদিকে আবু জাহেলের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনীর ৭০০ উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম ছিল। রণক্ষেত্রের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এই যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনী ছিল সুসজ্জিত ও শক্তিশালী এবং পূর্ণ যুদ্ধ সরঞ্জামে সুবিন্যস্ত। কুরাইশ বাহিনীর তুলনায় মুসলিম বাহিনীর প্রস্তুতি ও অবস্থান ছিল একেবারেই দুর্বল। মহান আল্লাহর সাহায্যের আবেদন করে রাসূলুল্লাহ (স.) যুদ্ধের আগের পুরো রাত মহান রবের নিকট এই বলে কান্না করে মুনাজাত করেন- “ হে আল্লাহ, তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ তা পূর্ণ করো। হে আল্লাহ, আমি তোমার ওয়াদার পূর্ণতা কামনা করছি।” যুদ্ধের দিন তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষে তুমুল যুদ্ধে মেতে ওঠে উভয়পক্ষ। এরপর কুরাইশরা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করে। মুসলিম বাহিনী প্রতিপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। কুরাইশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু জাহেলসহ ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন নেতাসহ ৭০ জন বন্দি হন। মুসলিম ১৪ জন মুজাহিদ শহিদ হন। বিজয় সুনিশ্চিত করে মুসলমানগণ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। 


পর্যবেক্ষণ: সত্যের জয় ও মিথ্যার শোচনীয় পরাজয় হয়েছে এইযুদ্ধে। ইসলাম নামক ধর্মকে পৃথিবী থেকে বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে কাফেররা পুরোপুরি পরাজিত ও ব্যর্থ হয়। বদরের এই ঐতিহাসিক বিজয় অদ্যাবধি ইসলাম ধর্মকে করেছে সুপ্রসন্ন ও বিস্তত। যুদ্ধের শৌর্যবীর্য ও সক্ষমতার দিক থেকে মুসলমানদের সংখ্যা, শক্তি ও সরঞ্জামাদি ছিল অপ্রতুল ও নগণ্য। মহান আল্লাহর আসমানী সাহায্য ও মুসলমানদের অদম্য ইমানী শক্তির বহিঃপ্রকাশের ফলে সুসজ্জিত বিশাল কাফের বাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে। এতদ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ কুরআনুল কারিমের সূরা আলে ইমরান এর ১২৩ নং আয়াতে উল্লেখ করেন। “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল । অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।” এই যুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য মহান আল্লাহ সরাসরি ফেরেশতাদের প্রেরণ করেন। এ প্র্রসঙ্গে আল কুরআনে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন- “ হে নবী! স্মরণ করুন যখন আপনি বিশ্বাসীগণকে বলেছিলেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।” (সূরা আলে ইমরান- ১২৪) মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলেন, “যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে প্রার্থনা করেছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের ফরিয়াদ কবুল করেছেন এবং বলেছিলেন, আমি তোমাদের জন্য পরপর এক হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করব।” (সূরা আল আনফাল ৯) কাফেরদের দাম্ভিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলমানদের এই বিজয় তাদের ইমানী শক্তি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বর্তমান মুসলমানগণ এই যুদ্ধ থেকে ইমানী শক্তিতে উজ্জীবিত ও বলীয়ান হওয়া অপরিহার্য। তবেই মহান আল্লাহ সাহায্য ও তাদের হারানো গৌরব পুনর্জাগরিত হবে। ইনশাআল্লাহ। 


লেখক-মো. নুরুল আমিন,অধ্যক্ষ, প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী কলেজ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।



প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024