২৬ মার্চ, ১৯৭১ একটি জাতির মুক্তির ঘোষণা, একটি নতুন ভোরের সূচনা। এই দিনটি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়, এটি বাঙালির শতাব্দীর সংগ্রামের ফসল। বিশ্ব ভূখন্ডে এক নতুন মানচিত্রের সূচনা । যার মাধ্যমে বিশ্বে পরিচয় ঘটেছে অন্যায়, অবিচার ও শোষনের বিরুদ্ধে বারুদ হয়ে ফুটে ওঠা এক বীরের জাতির। এই ইতিহাসের পটভূমি লক্ষ্য করলে দেখা যায় পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘ শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াই একদিনে শুরু হয়নি। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয়,প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের এক ভয়াল কালো অধ্যায়। ইংরেজ জনগোষ্ঠী চালু করে দ্বৈত শাসনের মতো অসংখ্য অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা। হারানো স্বাধীনতার সুখ ফিরে পেতে ভারতবর্ষের এই ভূখণ্ডে জনগোষ্ঠীরা ঐক্য বদ্ধ হয়ে বার বার বিদ্রোহ করেছে। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ,১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, খেলাফত আন্দোলনসহ অজস্র আন্দোলন। এই আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি মিললেও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তি মেলেনি। তাদের অসংখ্যবার পুড়তে হয়েছে শাসন শোষণের উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিতে। ১৯৪০ সালে পূর্ব বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ তথা পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষ্যে লাহোরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সম্মেলন।উক্ত সম্মেলনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন। যা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত। এর জের ধরে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পতন ঘটে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসন। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা বাঙালিরা ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান। মাঝখানে ১২০০ মাইলের ব্যবধান। তবুও স্বাধীনতার সুখ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধতে থাকে। তবে এই স্বাধীনতা কি আদৌ স্বাধীনতা নাকি শাসকের পরিবর্তন? ঠিক তাই ভারতবর্ষের মুক্তি মিললেও পূর্ব বঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠী তথা পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি হলো না। আবার নেমে এলো শোষিত নিপীড়িত মানুষের বুভুক্ষু হাহাকার।১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারে, তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। পশ্চিমারা তাদের রক্ত খেকো পিশাচের রূপ বের করতে শুরু করছে। এই হায়েনা গোষ্ঠী কেড়ে নিতে চাইল মুখের ভাষা। তবে বাঙালি কখনো চুপ করে বসে থাকার জাতি না। প্রতিবাদ যেন তাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। প্রতিবাদই যেন অগ্নি বৃষ্টি। তাই শুরু হলো প্রতিবাদ। রফিক শফিক বরকত সালামের রক্তের বিনিময়ে রক্ষা হলো প্রাণের ভাষা বাংলা। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ নামে পরিচিত। তবুও পাকিস্তানিদের বিন্দু মাত্র অনুশোচনা নেই। তারা শাসনের নামে শোষণ বন্ধ করেনি। রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতি সব কিছুতেই তাদের হস্তক্ষেপ, শুধু বৈষম্য ছাড়া আর কিছু নয়। শুরু হয় মুক্তির আন্দোলন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা পেশ করেন। আন্দোলন বেগবান হচ্ছে, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান এসবই ছিল স্বাধীনতার দাবির ভিত্তি। শেখ মুজিব হয়ে ওঠে মুক্তির মহা নায়ক, বাঙালির প্রাণের নেতা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। তখন আর প্রতিবাদের ভাষা কাজে দিচ্ছে না,অস্ত্রই যেন সত্যের কথা বলে। ধীরে ধীরে সময় কাছে আসতে লাগলো অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার। সময়টা ১৯৭১- ঘড়ির কাটা টিকটিক করে জানিয়ে দিচ্ছে এখনই মাহেন্দ্রক্ষণ, ধূলো জমা বাতাসে বইছে মুক্তির অগ্নিশিখা, রাজপথ থমথমে ভাব পূর্ব বঙ্গের প্রতিটি মানুষ মুক্তির আলোয় হয়ে উঠছে উদ্বীপ্তশিখা। শুধু মাত্র একটি বিশেষ কিছুর অপেক্ষায়। ১৯৭১ সালের সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আকাশ ফাটিয়ে বজ্রের মতো কন্ঠে বললেন- "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" কালজয়ী এই ভাষণ প্রতিটি বাঙালির রক্তের সাথে মিশে, প্রতিটি শিরা উপশিরায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে লাগলো। প্রস্তুত হতে না হতেই ২৫ মার্চের কালরাতে বাঙালিদের উপর নেমে এল মৃত্যুর ছায়া। বুলেট বারুদ আর রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠলো রাক্ষসী বাহিনী। এই রাক্ষসী পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায়—'অপারেশন সার্চলাইট' যা কাল রাত নামে পরিচিত। নারী, পুরুষ, যুবক,বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধী কেউ রেহাই পায়নি এই নৃশংস বর্বর হত্যাকাণ্ড থেকে। ঢাকার রাজপথ, পাড়া-মহল্লা রক্তে ভেসে যায়। পুরো ঢাকা শহর টাই যেন রক্ত উপত্যকায় পরিণত হলো। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এই বার্তা বাংলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন পাক বাহিনীর হাতে। এই ক্রান্তি লগ্ন পরিস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান তাৎক্ষনিক বাঙালিদের সংঘবদ্ধ হতে আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি পাঠ করেন। এরপর শুরু হয় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। জয় বাংলা স্লোগানেই মুক্তিবাহিনী খোঁজে পেত দ্বিগুণ শক্তি আর প্রাণ। বাঙালি প্রতিটি সন্তানই হয়েছিল এক একটি গেরিলা যোদ্ধা। জয়ের নেশাই ছিল তাদের চোখে মুখে। বুলেটের মতই তীক্ষ্ম ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা।দীর্ঘ নয় মাসের লড়াইয়ে দেখতে হয়েছে অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ, লাখো শহীদের রক্ত আর লাশের বন্যা। কত শত বিশ্বাসঘাতকের রক্তের সাথে বেইমানি আর লোম দাঁড় করানোর মত নারকীয় তাণ্ডব লীলা। হারাতে হয়েছে মা-বোনের সম্ভ্রম। গেরিলা যোদ্ধাদের সাহস,স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন আর সাধারণ মানুষের অবদান আর কোটি প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ার সজিব হোসেন
প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024