|
Date: 2025-04-07 06:45:40 |
একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না, এই প্রবাদটি আমরা সকলেই জানি অথচ আমাদের দেশে সেই দুর্ঘটনাই ঘটছে অহরহ, অবিরত। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলছে। প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। প্রতিদিন টিভি বা পত্রিকার পাতা উল্টালে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার খবর চোখে পড়ে। দুর্ঘটনা রোধে আইনকানুন ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকলেও তা প্রতিরোধ করা সম্ভর হচ্ছে না। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। এই আনন্দ বাড়িয়ে দেয় প্রিয়জনের সান্নিধ্য। প্রিয়জনের সঙ্গে উৎসবের আমেজ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ছুটে চলা মানুষের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রতিবছরই হারিয়ে যায় অনেক পরিবারের আপনজন। রাইজিংবিডি ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঈদের দিন (৩১ মার্চ) আট জেলায় সড়কে ঝরে যায় ১৬টি প্রাণ। অথচ সড়ক-মহাসড়কে সেদিন গাড়ি ছিল খুবই কম। সব মিলে ঈদের ছুটি শেষে হিসাব করলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা হয়তো শত ছাড়িয়ে যাবে। বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী , দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং প্রতি বছর গড়ে ২৪ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এক বছরে ৩ লক্ষের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী , গত ১০ বছরে দেশে ৬০ হাজার ৯৮০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাতে ১ লক্ষ ৫ হাজার ৩৩৮ জন নিহত এবং ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জন আহত হয়েছে। এভাবে আর কত! কবে বন্ধ হবে সড়কের মৃত্যুর মিছিল! বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৭৮ জন। আহত হন কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৭৮ ও শিশু ৮৭ জন। আর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহতের তথ্য দিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ওই মাসে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে নারী ৭২, শিশু ৮৪ জন। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৬৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। বিআরটিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে ২১৪ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩১ জন নিহত হয় এবং ২৮৩ জন আহত হয়। এভাবে বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনায় এবং মৃত্যুর হাহাকার। কিন্তু কোন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে! সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। এছাড়া ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালায়। ফলে একসময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব। গাড়ি চালকরা যখন গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরেন তখন তারা নিজেদেরকে রাজা ভাবেন। গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা সত্বেও তারা তা মানতে নারাজ। কেউ কেউ তো আছে যারা মদ পান করেই গাড়ি চালান। ফলে জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। গতকালের আব্দুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ টোল প্লাজার মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় বলে দেয় ড্রাইভার দের এমন চিত্র। আমাদের দেশে একটি কমন বিষয় হচ্ছে, যেখানেসেখানে গাড়ি পার্কিং করা। অনেক মানুষ আছে যারা গাড়ি কিনে টাকার জন্য ভাড়া দেয়। কিন্তু যে গাড়ি টি নিয়ে যায় সে অদক্ষ, মাদকাসক্ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক হতে পারে। সেক্ষেত্রে চালকের মাথায় একটি কথায় ঘুরপাক খায়, প্রথমে মালিকের টাকা পরিশোধ করা তারপর নিজের জন্য আয়৷ এই কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। এভাবেও অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে রাস্তায় গাড়ি চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যায় এই কারণেও ঘটে অনেক সড়ক দুর্ঘটনা এবং ফলস্বরূপ মৃত্যু। আমার মনে হয় আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার ফলেও বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তবে কয়জনেই বা আইন মানে! পথচারী কিংবা চালক কেউই মানতে চায় না আইন। এভাবেই নীরবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন শতশত মানুষ। এই দায়ভার কাদের! আর কত প্রাণ শেষ হলে আমরা সতর্ক হবো। প্রতিনিয়ত সড়ক রক্তাক্ত হচ্ছে কেন! তবে আমরা সড়কে আর মৃত্যু দেখতে চাই না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে, সিট বেল্ট বাঁধাতে হবে। নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য মনোযোগ থাকতে হবে। একটু অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের কারণে ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য। এখনই সময় সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বলার। হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানোর ফলে বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যা আমরা গতকাল আব্দুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ টোল প্লাজায় একটি মর্মান্তিক দূর্ঘটনা দেখেছি। তাই গাড়ির গতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনেক সময় ওভারটেকিং করার জন্য প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। প্রত্যেকটি গাড়ির দুটি লুকিং গ্লাস থাকতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় অনেক চালক নেশাগ্রস্ত থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বাসের দুর্ঘটনার কারণ নেশাগ্রস্ত চালক। তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনের ৮৪ ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১০৫ নম্বর ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর! সড়ক পরিবহন আইন এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তবে অনেকক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসতর্কতা এবং অসচেতনতার জন্য দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই শুধু আইনের বাস্তবায়ন নয় নাগরিকদের সচেতনতা সেইসঙ্গে কর্তৃপক্ষ,চালক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে,সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই আসুন সর্বদা নিজে সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি এবং সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করি।
-সাকিবুল হাছান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ,ঢাকা sakibulhasanlearning@gmail.com
© Deshchitro 2024