প্লাস্টিকের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্পী,অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। একটি চাকা ঘুরছে, আর সেই চাকার ওপর শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের হাঁড়ি, পাতিল, খেলনা’— একসময় এই দৃশ্য ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কুমারপাড়াগুলোর সাধারণ চিত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই মৃৎশিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে। লাখাই উপজেলার পুর্ববুল্লা কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীদের গল্পটাও ভিন্ন নয়। এখানকার ৩টি পরিবার এখনও মাটির তৈজসপত্র তৈরির কাজে যুক্ত, যদিও একসময় এই শিল্পে যুক্ত ছিল কয়েকটি পরিবার। এখন এই শিল্পীরা জীবন-জীবিকার জন্য অন্য পেশার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন। পুর্ববুল্লার কুমারপাড়ার প্রবীণ মৃৎশিল্পী সুনীল পাল জানান, “মাটির জিনিস তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের মাটি লাগে, যা হাওর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। যেকোনো মাটিতে এই জিনিস তৈরি করা যায় না। আগে আমরা আমাদের নিকটবর্তী নদীর চরের মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতাম এখন দূষণের ফলে আর আমাদের বাড়ির কাছের মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতে পারছি না। আমাদের এখানে মাটি প্রস্তুতের জন্য কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। আমরা এখনো হাত-পা দিয়েই সনাতন পদ্ধতিতে মাটি মেখে প্রস্তুত করি।” তিনি জানান, মাটির তৈরি জিনিসের উৎপাদন প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। মাটি চাকার ওপরে বসিয়ে থালা, বাটি, দইয়ের মালশা, পানির পাত্রসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো রোদে শুকানো হয়, লাল মাটির তরলের মধ্যে ডুবিয়ে রঙ করা হয়, এবং পরবর্তীতে একসাথে পুড়িয়ে বাজারজাত করা হয়। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় লাভ যে খুব সামান্য, তা সুনীল পালের কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, “এক মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ করলে লাভ থাকে মাত্র ৮ হাজার টাকার মতো। পরিবারের সবাই মিলে দিন-রাত পরিশ্রম করেও তেমন কিছু থাকে না। দোকানদাররা আমাদের কাছ থেকে ১০ টাকায় যে মালামাল কেনে, সেটাই ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করে। ফলে প্রকৃত শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।” প্রবীণ আরেক মৃৎশিল্পী বাসন্তী পাল বলেন, আমাদের হাতের তৈরি মাটির জিনিসপত্র একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হতো। পাশের নদী দিয়ে নৌকা বোঝাই করে মালামাল পাঠানো হতো। কিন্তু এখন সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তো আমাদের গ্রামেই মাটির হাঁড়ি-বাটি নেওয়ার লোক পাওয়া যায় না।” এই শিল্পকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে তুলতে সরকারি সহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। বাসন্তী পাল বলেন, “বিদ্যুৎচালিত চাকা পেলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হতো। এতে নতুন প্রজন্মেরও আগ্রহ তৈরি হতে পারত। হাতে চালিত বড় চাকায় কাজ করতে অনেক কষ্ট হয় তাই এখন আর কেউ এই কাজ শিখতে চায় না, কারণ এতে কষ্ট বেশি আয় কম।” মালতী রানী পালও একজন মৃৎশিল্পী। ছোটবেলা থেকে বাবার বাড়িতে বসে মাটির কাজ করতেন, এখন স্বামীর বাড়িতেও তাই করেন। তিনি বলেন, “মাটির হাঁড়ির পানি ঠান্ডা থাকে, মাটির পাত্রে রান্না করলে খাবারের স্বাদ আলাদা হয়। কিন্তু মানুষ এখন প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম আর মেলামাইনের দিকে ঝুঁকেছে। এতে শুধু আমাদের কাজ কমেনি, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে।” তিনি আরও জানান, এখন ব্যবসায় লাভ কমে গেছে বলে নতুন করে কেউ আর এই পেশায় আসতে চায় না। কষ্ট এবং অলাভ জনক হওয়ায় অনেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। হয়তো ১০-১৫ বছর পর এই গ্রামে আর কোনো মৃৎশিল্পীই থাকবে না।” পুর্ববুল্লা গ্রামের রবীন্দ্র পাল বলেন, ‘‘বাড়িতে বসে যে মালামাল তৈরি করি সেগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি কোথাও মেলা হলে সেখানে নিয়েও বিক্রি করি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের প্রভাবে আমাদের এই পণ্যের চাহিদা কমেছে। মেলাতেও এখন বেচাকেনা কমে গেছে। এখন ফুলদানি, ডিনার সেট, চায়ের কাপ সহ মাটির তৈরি কিছু সৌখিন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রচারের অভাবে মালামাল বিক্রি হচ্ছে না। আমি এই পেশায় ৪০ বছর ধরে আছি। আমার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে অন্য পেশায় দিতে চাই। এই পেশার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই পুর্ববুল্লা গ্রামের কুমার পাড়ায় বর্তমানে ৩টি পরিবার মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখলেও, কেউ কেউ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, কেউ বা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়দের আশা, যদি মানুষ আবার মাটির তৈরি জিনিসের দিকে ফিরে আসে, যদি পরিবেশ রক্ষার জন্য এই পণ্যকে জনপ্রিয় করা হয়, তাহলে হয়তো আবারো কুমার পাড়ার ঘরে ঘরে চাকা ঘুরবে মৃৎশিল্পের। জনপ্রতিনিধি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে মৃৎশিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। কম সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে, যাতে তাঁরা বড় পরিসরে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারেন। মাটির তৈরি পণ্যকে বাজারজাত করার জন্য সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক ও মেলামাইনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024