বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হবে তা আমরা সবাই অনুধাবন করতে পারছি। শুধু তাই নয় এর প্রয়োজনীয়তা আমাদের বিভিন্নভাবে চোখ ভাসছে এবং অনুভব করছি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তার জন্য যতটুকু কাজ করা প্রয়োজন তা পারছি না। বিশে^ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন জরুরি।  সাধারণ শিক্ষায় আমরা যে শিক্ষা অর্জন করছি তা বাস্তবিকতায় খুব একটা কাজে আসছে না এবং যে পরিমাণে চাহিদা রয়েছে বাস্তব ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি লোকবল রয়েছে বর্তমানে। তাই সাধারণ শিক্ষায় বিনিযোগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কারিগরি শিক্ষায় বিনিযোগ বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে তার বাস্তব জীবনে ব্যবহার করে কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হতে পারে তাই কারিগরি শিক্ষা। আর উপযুক্ত বৃত্তি বা পেশা নির্বাচনের জন্য দক্ষতামূলক যে শিক্ষা, তাকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলে। সমস্যাটা হলো নীতিনির্ধারকরা সবাই বলে কিন্তু কেউ করার জন্য সামনের ভূমিকা রাখতে পারছে  না। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করছি ঠিকই কিন্তু প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি না। তাই মন্থর গতি ও পুরাতন কারিগরি শিক্ষার মডেলকে পরিবর্তন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এই যে আমরা বলছি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে দিনদিন এর একমাত্র কারন সঠিক কারিগরি জ্ঞান অর্জনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ। কারিগরি জ্ঞান অর্জনের জন্য বর্তমান কারিগরি শিক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করে অধিক বিনিয়োগের মাধ্যমে সময়োপোযোগি করে সাজাতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছি আসলে কি আমরা তা দিতে পারছি ?  স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি পৃথিবীর সাথে চলমান একটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা দাঁড় করাতে পারছি না। এই ব্যর্থতা আমাদের অন্যসব অর্জনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারছে না। শিক্ষার অগ্রাধিকার বিষয়টি কি ? আমরা মনে করছি প্রতি বছর সরকার যে বাজেট বরাদ্ধ দেয় তা যদি বাড়ানো হয় তাহলে আমরা বুঝি অনেক অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা হাস্যরসের মতো। তবে হ্যাঁ এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে অর্থ বরাদ্ধ বৃদ্ধি অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যত কথাই বলি না কেন বরাদ্ধ না বাড়ালে আধুনিক শিক্ষায় অন্যান্য উদীয়মান দেশের সাখে তাল মেলানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে একটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও একটি অধিদপ্তর। সারা বছরই শুনা যায় লোকবলের সংকট যার প্রেক্ষিতে তারা সারা দেশের কার্যক্রম তদারকি করতে পারছে না। অন্য শিক্ষার সকল কার্যক্রমের চেয়ে তারা পিছিয়ে। সাধারণ শিক্ষার কর্তা ব্যক্তিরা যা করছে তা থেকে দেখে দেখে তারা প্রযোগ করছে অথচ তাদের কাছ থেকে সাধারণ বিভাগের জ্ঞান নেয়ার কখা ছিল।  অগ্রাধিকার আর গুরুত্বের কথা মালা সাজিয়ে প্রতিনিয়তই কর্তাব্যক্তিরা এই শিক্ষা কার্যক্রমের সুবাস ছড়িয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষা ব্যবস্থার বেশির ভাগ শাখার এতই দূর্বল অবস্থা যে আমাদের ভবিষৎত প্রজন্মকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যবহারিক দিক কিন্তু সারা দেশে কারিগরি শিক্ষায় যে বিভাগ রয়েছে তার কতগুলো শাখায় সঠিকভাবে ব্যবহারিক পাঠদান হচ্ছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি ? এই যে ব্যবহারিক দিকের দূর্বলতা তৈরি হচ্ছে তা থেকে আদৌ দক্ষ জনবল তৈরি করা কি সম্ভব ? আর সবচেয়ে বড় দিক হলো এ শিক্ষাটা কে আমরা তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষায় পরিণত করেছি। একটা দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যারা লেখা পড়ায় অমনোযোগি বা মেধা কম তাদের জন্য যেন এই কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা। যদি কোথাও ভালো ফলাফলের অভাব দেখা দেয় তখনই অভিভাবক চিন্তা করেন একটা কিছু করতে হবে তাই তাকে কারিগরির কোন শাখায় ভর্তি করতে হবে। কিন্তু ভেবে দেখি নাই এই শিক্ষার জন্য কার কি রকমের মেধা প্রয়োজন। মেধাবী শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায় তাদের মেধা বিনিয়োগ করলে পরিবর্তন হতে পারে এ শিক্ষা এটা ভাবা দরকার। দেশ ও পরিবারের অর্থনৈতিক চেহারা পরিবর্তন হতে পারে কতটা সেটা ভাবতে হবে । এ বিষয়ে মনের দিকটার পরিবর্তন প্রয়োজন এছাড়াও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা ব্যাপার থেকেই যায়। সারাদেশে কারিগরি বোর্ড থেকে কি পরিমাণ কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা কি আমরা লক্ষ্য করছি ? এদের মান নিয়ে আমরা কি ভাবছি ?  তা থেকে কেবল সার্টিফিকেট সর্বস্ব চাকুরির ব্যবস্থা করছি। এ প্লাস সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছি কিন্তু কম্পিউটার অন করতে পারছি না। সারা দেশে প্রায় প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব এর ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ ল্যাবই অচল রয়েছে। কি পরিমাণ ডিপ্লোমাধারী বেকারের জন্ম দিচ্ছি তার পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই শুধু বলছি চাকুরির বাজার নেই। কেউ ডিগ্রি নেওয়ার পর নিজকে আলাদা করে ভাবছি না তাদের অন্যতম কারন আমরা প্রকৃত শিক্ষাটা অর্জন করতে পারছি না।  শিক্ষাটাকে আমরা টাকা রোজগারের হাতিয়ার বানিয়েছি ঠিকই কিন্তু পথটা এখনও সঠিকভাবে দেখাতে পারছি না। বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অনেকগুলো ডিপ্লোমা রয়েছে। এইসব ডিপ্লোমা কোর্স পড়ানোর জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য যেসব ধরণের অভিজ্ঞ শিক্ষক মন্ডলী এবং অবকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে তা আছে কি না তা কিন্তু সঠিকভাবে যাচাই করা হচ্ছে না। এইসব কোর্স পড়ানোর জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে তা অনেকটা ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির মতো। প্রয়োজনী শিক্ষক ও অবকাঠামো না থাকা এবং তদারকির অভাবে এসব প্রতিষ্ঠান মানহীণ আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলছে যার খেসারত দিতে হবে পুরো জাতিকে। শুধুমাত্র পরিকল্পনায় বস্তাবন্দি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ বস্তাবন্দি অবস্থা থেকে বের করে সুন্দর একটি কাঠামো গঠন করতে হবে দলীয় লেজুরভিত্তির বাইরে এসে। অন্তত পক্ষে শিক্ষাটাকে আলাদা করে ভাবতে হবে। কারিগরি শিক্ষাটা এমন এক জায়গায় নিতে হবে যাতে করে আমাদের দেশের শ্রম বাজার হয় আন্তর্জাতিক মানের।


  

লেখক পরিচিতি

শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক 


প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024