|
Date: 2025-05-31 15:56:03 |
তামাকের ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন। তামাক গাছের শুকনো পাতাকে তামাক বলা হয়। তামাক অত্যন্ত নেশাদায়ক পদার্থ। তামাকে আগুন দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকো ও অন্যান্য ধুমপানের মাধ্যম প্রস্তুত করা হয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষ এটা ব্যবহার করে আসছে নিজেরদের সুবিধা অনুযায়ী। আবার তামাকের প্যাকেটের উপরে স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক বিভিন্ন কথা লিখা থাকলেও এর ব্যবহার কোন অংশেই কমছে না বরং দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্নভাবে। এই ব্যবহার বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে ভাবিয়ে তুলছে কারন তামাকের ব্যবহারের মাধ্যমেই অন্যসব নেশা জাতীয় দ্রব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে মানুষ। বলা চলে তামাক অন্য সব নেশার প্রথম ধাপ। আজ ৩১ মে পালিত হচ্ছে বিশ^ তামাকমুক্ত দিবস। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য: “তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিন মুক্ত বাংলাদেশ গড়ি”। অন্তত পক্ষে একটি দিন তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটির প্রচলন করা হয়। এছাড়াও দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো যা বর্তমানে প্রতি বছর বিশ^ব্যাপী ৬০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারন হিসেবে বিবেচিত এবং যার মধ্যে ধূমপানের পরোক্ষ ধোঁয়ার প্রভাবের কারণে প্রায় ৬ লক্ষ অ-ধূমপায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৩ সালের বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তামাক ব্যবহারের ফলে বিশে^ প্রতি বছর ৮ মিলিয়নেরও বেশি মারা যায়। তামাক এবং ধূমপানে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, অগ্ন্যাশয়, মুত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীর মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০ ধরনেও বেশি ক্যান্সার রোগের সৃষ্টি করে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন এর অত্যন্ত আসক্তি এবং ফলে তামাকের ব্যবহার কার্ডিওভাসকুলার ও শ^াসযন্ত্রের রোগসহ অন্যান্য রোগ দুর্বল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকির কারণ। তামাক অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক হতে পারে। সেকেন্ড-হ্যান্ড ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রতিকূল ফলাফলের সঙ্গে জড়িত। যার ফলে বছরে ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে। তার মানেটা হলো তামাক সেবনের ফলে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি অন্য মানুষেরও ক্ষতির কারণ হচ্ছেন ধূমপায়ীরা। বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকাজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিযন্ত্রণ) আইন-২০০৫ নামে একটি আইন রয়েছে। এই আইনের ৪। (১) ধারা ৭ এর বিধান সাপেক্ষে, কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্রেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করিতে পারিবেন না। ধূমপান করিলে ৩শ টাকা জরিমানা ও পুন: পুন: ধূমপান করিলে জরিমানা দিগুণ হইবে বলে আইনে রয়েছে। এবং এই আইনের মাধ্যমে তামাকজাত পণ্যের উপর বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কি দেখা যায় ? আমরা কি সেই আইন মানছি ? কিংবা এই আইন মানানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কি কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ? কিংবা জনসাধারণকে কতটুকু এই আইন সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। সবই কেবলি লোক দেখানো মনে হয়। অন্যদিকে ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা, গুল এবং সাদাপাতাসহ বিভিন্ন আকরে পাওয়া যায় এবং তাদের দাম কম গওয়ায় সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ক্রয় ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য কম দাম তামাকজাত পণ্য সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তোলা রোধ করতে তামাকের ওপর অধিকতর কর আরোপ একটি কার্যকর কৌশল বলে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশের কর কাঠামো বেশ জটিল এবং ভিত্তিমূল্য এখনও খুবই কম। এর পেছনেও যে তামাক কোম্পানির অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লোবাল টোব্যাকো ইনডেক্স ২০২০ অনুসারে ৫৭টি দেশের মধ্যে ২৭তম স্থানে রয়েছে আমাদের দেশ। দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। এই তরুণদের হাতেই চলে আসছে সিগারেট। বিশ^ব্যাপি অনুমান অনুসারে. ১০জন ধূমপায়ীর মধ্যে প্রায় ৯জনই ১৮ বছর বয়সের আগে ধূমপান শুরু করে এবং ৯৮ শতাংশ ২৬ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের উচ্চ উৎপাদন এবং সেবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যার ফলে তামাকজনিত অসুস্থ্যতার একটি ভারী বোঝা তৈরি হচ্ছে এ দেশে। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৩০ হাজার কোটি টাকা চিকিৎসা ব্যয় হয়। এই তামাক উৎপাদন ও বিক্রয় এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা যতই বিধি নিষেধ আরোপ করি না কেন তা থেকে সঠিক ফল আশা করা কঠিন কারন এটি নেশা জাতীয় দ্রব্য। প্রতি বছরই বাজেট আসার আগে ব্যবসায়ীদের মাঝে তামাকজাত দ্রব্য মজুদ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তার কারণ হলো ধরেই নেওয়া হয় যে বাজেটে এর দামেরে উপর প্রভাব পড়বে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এত দাম বৃদ্ধির পরও কি এর ব্যবহার কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই নেশাজাতীয় দ্রব্যগুলো বাজারে যে হারে খোলাভাবে বিক্রি করা হচ্ছে তা উদ্বেগ তৈরি করছে। তাই এই সব দ্রব্য বিক্রি করার জন্য নূন্যতম বয়সের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মানুষের হাতে তা বিক্রি করা উচিত। একসময় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনের সময় সামাজিকভাবে বড় ছোটর একটা ভেদাভেদ লক্ষ্য করা যেত যা সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। সমাজের কাছে একসময় এটা ভালো কাজ বলে গণ্য হতো না। সবাই এটা আড়াল করেই সেবন করতো যদিও এটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা ভার। তাই নেশা জাতীয় পণ্যের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আরো সজাগ থাকতে হবে এবং তা উৎপাদন ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আরো দৃষ্টি দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ ব্যাপারে আরো বেশি সামাজিক জোয়ার তৈরি করতে হবে এবং এর কুফল সম্পর্কে পাঠ্যক্রমে আরো শক্ত অবস্থান তৈরি করতে করতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর নেতিবাচক প্রভাব গুলো তুলে ধরতে হবে। সর্বোপরি এব্যাপারে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
© Deshchitro 2024